318223

সাহসিকতার সাথে করোনাকে পরাজিত করা কানাডিয়ান প্রবাসী দম্পতির বিজয়গাঁথা

প্রবাস ডেস্ক।। কানাডায় এই মুহূর্তে কভিড-১৯’এ আক্রান্ত হবার পর এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১১ হাজার ৮৪৩ জন। তাদের মধ্যে আলবাট্রার এডমিন্টনের দম্পতি ফয়সল-ফারহানা। পর-পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজের বাসায় ঘর বন্দি থেকে, সকল নিয়ম মেনে এবং সাহসিকতার সাথে একেবারে আগের মতো ফুরফুরে জীবনে ফিরে এসেছেন।

এই ফিরে আসার ঘটনা তাঁরা দু’জনেই বর্ণনা করলেন ইত্তেফাকের কাছে। ফয়সল ফেরদৌস এবং চৌধুরী ফারহানা ফারুকী দু’জনেই ফার্মাসিস্ট। এ ছাড়াও তারা নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। ফয়সল বাংলাদেশ-কানাডা এসোসিয়েশন অফ এডমোন্টন-এর সাধারণ সম্পাদক আর উপস্থাপিকা ফারহানা এই সংগঠনের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাদের চাচা টরন্টোর নয়ন হাফিজও একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তি। প্রথমে নয়নের মাধ্যমে এদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ওরা প্রথমে টরন্টোতে আমার বাসায় থাকতো। পরে এডমনটনে চলে যায়। সরাসরি ওদের সাথে কথা বলেন। সেটাই ভালো।

ফারহানাকে ফোন করলে ফারহানা বলেন, আমার স্বামী ফয়সল ফেরদৌস কাজের জায়গা অর্থাৎ ফার্মেসি থেকে গত ২৩ মার্চ এক সহকর্মীর মাধ্যমে ভাইরাসের কবলে পড়েন। যদিও তিনি সামাজিক দূরত্ব (স্যোশাল ডিসটেন্স) বজায় রেখেছিলেন, হাত ধুয়েছিলেন, হাত স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছিলেন তারপরও আক্রান্ত হন। তার একটাই ভুল ছিলো, পুরো সময় মাস্ক ব্যবহার করেন নি। পরে তার এএইচএস পরীক্ষার পর কভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পরে।

প্রথমে তাঁর হালকা লক্ষণ দেখা যায়। যেমন, মাথা ব্যথা, হালকা জ্বর, সামান্য শ্বাসকষ্ট এবং ডায়রিয়া। সাথে সাথে আমরা তাকে আলাদা ঘরে আইসোলেশনে রাখি এবং আমাদের ওয়াশরুমগুলিও আলাদা করি। বলতে পারেন একবারে কক্ষ বন্দি।

আমি এবং আমাদের ১১ বছরের ছেলে আয়ান পৃথক হয়ে থাকি। আমাদের যোগাযোগ হতো টেলিফোনে। এই অবস্থায় ডাক্তারও টেলিফোনে চিকিৎসা এবং পরামর্শ দিতে থাকেন। ফয়সল তা শতভাগ মেনে চলে। সাবধানে থেকে সে বর্তমানে শতভাগ সুস্থ।

এরই মধ্যে ফারহানা নিজেই আক্রান্ত হয়ে এই ভাইরাসের উপসর্গ টের পেতে থাকেন। সাথে সাথে তিনিও চলে যান আইসোলেশনে। মাঝখানে দু’দিন ছেলে একা একা সব কিছু করতেন। এই সব অসহায় দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে ফারহানা জানান, নিউ ইয়র্কে তার চাচার বাসায় ১০ জন এক সাথে করোনায় আক্রান্ত। ইতোমধ্যে চাচাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ফোনে কথা বলতে বলতেই নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন এলো যে, করোনায় আক্রান্ত চাচা হাসপাতালে ভীত হয়ে হার্ট অ্যাটাক করে একটু আগে মারা গেলেন।

তখন কথা হয় ফয়সলের সাথে। ফয়সল বলেন, আমি খুব আশাবাদী এবং সাহসী। এক মুহূর্তের জন্যও মানসিক ভাবে দুর্বল হইনি। কারণ, আমি একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে জানি- আমার কি করতে হবে, কি করা উচিত। কারণ, আলবাট্রায় ফার্মাসিস্টরা রোগী দেখতে পারে এবং প্রেসক্রাইব করতে পারে।

ফয়সল আরো জানান যে, ঠাণ্ডা-হাঁচি-কাশি-ফ্লু থেকে শরীরকে মুক্ত রাখলে সহজে করোনা আক্রান্ত করতে পারবেনা। তাছাড়া ফ্লু শট হলে ‘ওসেল টামেভির’ এর প্রাথমিক চিকিৎসা। তবে কেউ উপদেশ বা উপকার করতে এসে যদি ডাক্তারি করেন, তবে ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হতে পারে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্যানিক না হওয়া। প্যানিক হলে শরীরে নানান উপসর্গ দেখা যায়, যা করোনার জন্য মারাত্মক ফল নিয়ে আসবে। শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, আমি মানসিক ভাবে আরো বেশি দৃঢ় ছিলাম। আমার এক ভাই নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত ছিলো। আমি আমার অভিজ্ঞতা তাকে জানিয়েছি। আমরা সঠিক কাউন্সিলিংয়ে সে এখন সুস্থ বোধ করেছি।

এদিকে ফারহানা সুস্থ হয়ে গত ১৮ এপ্রিল তার উৎকণ্ঠিত করোনায় কারাবন্দী জীবনের কথা ফেসবুকে তুলে ধরলে তা প্রায় অর্ধশত শেয়ার হয় এবং দেশে-বিদেশে ইতিবাচক সাড়া সৃষ্টি করে। সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, আমি দশ দিন আলাদা ঘরে থাকি। সেই দিনগুলিতে আমি আমার ছেলেকে দেখতে পাইনি। আমার স্বামী ততক্ষণে সুস্থ হয়ে উঠলো এবং ছেলের যত্ন নিলো। ভাগ্যক্রমে আমাদের ছেলে আয়ন সুস্থ আছে। এখনও তার কোনো লক্ষণ নেই।

একজন ফার্মাসিস্ট এবং করোনায় আক্রান্তের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমার স্বামীর হার্টের সমস্যা এবং আমাদের দু’জনেরই ডায়াবেটিস রয়েছে। আমরা নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করে চলেছি এবং প্রতি ৬ ঘণ্টা বা যখনই আমরা জ্বর বা মাথা ব্যথা অনুভব করেছি তখন টাইলেনল (প্যারাসিটামল) ৫০০ মিলিগ্রাম গ্রহণ করেছি। আমরা গরম পানি এবং চিনি ছাড়া আদা চা পান করেছি। আমি প্রতিদিন ৩/৪ বার ভিটামিন সি ট্যাবলেট নিয়েছি। মুখে কোন স্বাদ ছিলো না, খেতে পারতাম না। তবে যতটা পারি খেয়েছি। যখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তখন আমি শ্বাসকষ্টের কিছু ব্যায়াম করেছি। কোভিড-১৯ এর জন্য আমরা কোনও অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করি নি।

আমরা সুস্থ হয়ে আমাদের ব্যবহৃত সমস্ত কাপড়-চোপড়, বিছানার চাদর, কম্বল, বাসন-কোসন ভালো করে পরিষ্কার করেছি। পরিষ্কার করেছি পুরো বাসাটা। এএইচএসের পরামর্শ অনুযায়ী ১৪ দিন পরে কাজ শুরু করেছি। এখন নিয়মিত কাজে যাচ্ছি।

ফারহানা আত্মীয়-স্বজন, শুভার্থী, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আরো বলেন, আমি সকলের আন্তরিকতা আর ভালোবাসা পেয়ে কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সেই দুঃসময়ে কমিউনিটির অনেকই বাসার সামনে খাবার-দাবার রেখে গেছেন। আমাদের ফার্মাসি ম্যানেজার ওষুধ, স্ন্যাকস এবং ভিটামিন দিয়ে গেছেন। আমি অভিভূত, আপ্লুত, গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ!

ফারহানা ইত্তেফাককে আরো বলেন, করোনা হলে এখন আর কেউ একা নয়; সবাই চারপাশে আছেন, হাত বাড়িয়ে আছেন। কাজেই কেউ হতাশ হবেন না। কারণ, মানুষের জন্যই মানুষ।

তিনি বলেন, আমার একটা অনুরোধ, আপনারা যখন কোনও জরুরি কাজে ঘরের বাইরে যাবেন, তখন মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে যাবেন। বাহিরের জন্য ভিন্ন পোশাক পরুন, ঘরে এসেই আপনার পোশাক পরিবর্তন করুন, বাইরে থেকে ঘরে ঢুকাই হাত স্যানিটাইজ করে পরিষ্কার করে নিবেন। পোশাক খুলে আলাদা করে রেখে ধুয়ে নিবেন। উৎস: ইত্তেফাক।

ad

পাঠকের মতামত