263394

আত্মসমর্পণের পথে দেড় শতাধিক ইয়াবা গডফাদার

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কক্সবাজার জেলার টেকনাফের একশজনের ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করছেন শনিবার। তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশের এক নম্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল করিমসহ অন্তত ২৫ জন গডফাদার। আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক হিসেবে পুলিশের ‘সেফ হোমে’ আশ্রয় নেওয়া ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় রয়েছেন রাজনীতিক এবং জনপ্রতিনিধিও। কক্সবাজার জেলা পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এইসব ইয়াবা পাচারকারীরা আত্মসমর্পণ করবে বলে জানা গেছে। সকাল ১০টায় টেকনাফ পাইলট স্কুল মাঠে হবে বহুল প্রত্যাশিত এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘদিন এ ব্যবসা থেকে অর্জন করা অর্থের মায়া ভুলে প্রায় শখানেক ইয়াবা কারবারি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন জানিয়েছেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এতে আমন্ত্রণ জানানো হবে।জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে প্রতীকীভাবে ইয়াবা ট্যাবলেট জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে প্রায় ১২০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন গডফাদার। আত্মসমর্পণের জন্য এরই মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জিম্মায় এসেছে তারা। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত থাকবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, ৬৯ জন ইয়াবা কারবারি রয়েছে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে। তাদের কলাতলী বাইপাস সড়কে অবস্থিত জেলা পুলিশ লাইনের অভ্যন্তরে ইনসার্ভিস পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার ভবনে রাখা হয়েছে।ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনলে তিনিও এতে সম্মতি দিয়েছেন। এরপরই জেলা পুলিশ এ নিয়ে কাজ শুরু করে। আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো মামলা রুজু হবে না। পুরনো মামলাগুলো তাদের আইনিভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের সুপথে ফিরতে সরকার সহায়তা করবে।

টেকনাফের কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রতিদিনই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কেউ না কেউ নিহত হচ্ছে। তাই ভয়ে তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এ আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সঙ্গে থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের অনেকে আত্মসমর্পণ করার জন্য যোগাযোগ করেছে। যারা আত্মসমর্পণ করতে আসছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, প্রায় ৪৫০ জন নতুন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম জানা গেছে, যারা তালিকাভুক্ত নয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো থানায় মামলাও নেই। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তারা দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের বেশিরভাগ সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের। ভয়াবহ মাদক ইয়াবার বিরুদ্ধে গত বছরের ৪ মে থেকে শুরু হয়েছে বিশেষ অভিযান। এ পর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৪২ কারবারি। এর মধ্যে ৩৭ জনই টেকনাফের। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৭৩ জন গডফাদারের মধ্যে মাত্র চারজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ বিষয়ে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, কোনো খুচরা ইয়াবা ব্যবসায়ী ও বহনকারীকে আত্মসমর্পণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়নি। যারা আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তারা সবাই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদার।

যারা আত্মসমর্পণ করছেন: আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও টেকনাফের স্থানীয় লোকজনের বরাতে অনেক ইয়াবা কারবারির নাম পাওয়া গেছে, যারা আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশের ‘সেফ হোমে’ আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন দেশের এক নম্বর ইয়াবা কারবারি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিলবনিয়াপাড়া গ্রামের ডা. হানিফের ছেলে হাজি সাইফুল করিম, সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির তিন ভাই, উপজেলা চেয়ারম্যান পুত্র, পৌর কাউন্সিলর, ৫ জন ইউপি সদস্য রয়েছেন।

সূত্রমতে, পুলিশের সেফহোমে রয়েছেন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির তিন ভাই যথাক্রমে শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান ও বদির ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু এবং সাহেদ কামাল। এছাড়াও রয়েছে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ এর পুত্র দিদার মিয়া ও পৌর কাউন্সিলর নুরুল বশর প্রকাশ নুরশাদ। রয়েছে ৫ জন ইউপি সদস্যও। তারা হলেন, যথাক্রমে টেকনাফের পশ্চিম লেদার নুরুল হুদা মেম্বার, নাজিরপাড়ার এনামুল হক মেম্বার, সাবরাংয়ের মোয়াজ্জেম হোসেন প্রকাশ ধানু মেম্বার, আলী খালির জামাল মেম্বার, শাহপরীর দ্বীপের রেজাউল করিম মেম্বার। অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন আলী আহমদ চেয়ারম্যানের দুই পুত্র আবদুর রহমান ও জিয়াউর রহমান, হ্নীলার পশ্চিম সিকদার পাড়ার ছৈয়দ আহমদ, নাজিরপাড়ার আবদুর রহমান, পুরাতন পল্লান পাড়ার শাহ আলম, জাহাজপুরার নুরুল আলম, হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ার রশিদ আহমদ, ওয়ালিয়াবাদের মারুফ বিন খলিল বাবু, মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, মধ্যম ডেইল পাড়ার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, চৌধুরী পাড়ার মং সং থেইন প্রকাশ মমচি ও দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার জুবাইর হোসেন, হ্নীলা পূর্ব পানখালীর নজরুল ইসলাম, পশ্চিম লেদার নুরুল কবীর, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোছন, নাইটং পাড়ার মোঃ ইউনুচ, সাবরাং আলীর ডেইল এর জাফর আহমদ, হ্নীলা ফুলের ডেইল এর রুস্তম আলী, শামলাপুর জুমপাড়ার শফিউল্লাহ, একই এলাকার ছৈয়দ আলম, উত্তরলম্বরীর আবদুল করিম প্রকাশ করিম মাঝি, রাজারছড়ার আবদুল কুদ্দুছ, জাহেলিয়া পাড়ার মো. সিরাজ, সাবরাংয়ের আবদুল হামিদ, নাজিরপাড়ার মো. রফিক, নতুন পল্লান পাড়ার মো. সেলিম, নাইট্যংপাড়ার মো. রহিম উল্লাহ, নাজির পাড়ার মো. হেলাল, চৌধুরী পাড়ার মোহাম্মদ আলম, তুলাতলীর নুরুল বশর, হাতিয়াঘোনার দিল মোহাম্মদ, একই এলাকার মোহাম্মদ হাছন, দক্ষিণ নয়াপাড়ার নুর মোহাম্মদ, সদর কচুবনিয়ার বদিউর রহমান, পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম, মধ্যম জালিয়া পাড়ার মোজাম্মেল হক, ডেইল পাড়ার আবদুল আমিন, উত্তর আলী খালীর শাহ আজম, দক্ষিণ নয়াপাড়ার আলমগীর ফয়সাল, সাবরাং ডেইল পাড়ার মো. সাকের মিয়া, সাবরাংয়ের আলী আহমদ, উত্তর শীলখালীর মো. আবু ছৈয়দ, জাদিমুরার মোহাম্মদ হাসান আবদুল্লাহ, রাজার ছড়ার হোসেন আলী, সাবরাং নয়া পাড়ার মো. তৈয়ব, উত্তর জালিয়া পাড়ার নুরুল বশর মিজি, নাজির পাড়ার জামাল হোসেন, মৌলভী পাড়ার মো. আলী ও এই এলাকার আবদুল গনি।

আলোচনায় হাজি সাইফুল-হাজি সাইফুল করিম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় দেশের এক নম্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী তিনি। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে হয়েছেন ব্যবসা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি)। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বিস্তৃত তার ব্যবসা। কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা হলেও থাকেন চট্টগ্রামে। ‘এস.কে. ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তিনি। গার্মেন্টস, আমদানি-রপ্তানি, কার্গো ও জাহাজের ব্যবসা রয়েছে তার। চট্টগ্রাম শহরের কাজীর দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারে রয়েছে তার একাধিক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট। কক্সবাজারের কলাতলী পয়েন্টে হোটেলও নির্মাণ করছেন। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সিআইপি শিল্পপতি সাইফুল এখন শত কোটি টাকার মালিক। অল্প সময়ের মধ্যে তার এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা আলাদীনের চেরাগের নাম ইয়াবা।

পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় বিগত দীর্ঘ সময় ধরে বহাল তবিয়তে থাকা এ ইয়াবা ব্যবসায়ী এবার আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তার আত্মসমর্পণের বিষয়টি এখন সব মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডুর প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে দেশে সরাসরি ইয়াবার চালান নিয়ে আসা এবং চট্টগ্রামে নিয়ে পাচার করার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে সাইফুলের। তাকে আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিও বলা হচ্ছে। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও টাকার দাপটে বরাবরই থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রভাবশালী সাইফুল কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও বহাল তবিয়তেই ছিলেন। তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন চট্টগ্রামে কর্মরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ১৪১ শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় ডিএনসি। এর বাইরে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ১১০ জন মাদক কারবারির তালিকা সংগ্রহ করেছে দুদক। সবগুলো তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হাজী সাইফুলের নাম। ডিএনসির চট্টগ্রাম অঞ্চলের তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে তার নাম। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিলবনিয়াপাড়া গ্রামের ডা. হানিফের ছেলে এই সাইফুল।

গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে ইয়াবা কারবারে জড়িত সাইফুল। ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করতেন। বিয়ে করেন টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহর বোনকে। সরকার বদল হলেও তার মাদক কারবার কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি। বরং বেড়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় থেকে ভোল পাল্টে নেন সাইফুল। শুরুতে টেকনাফ ও কক্সবাজারে থেকে কারবার পরিচালনা করলেও ২০১১ সালের পর চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক ইয়াবার কারবার শুরু করেন সাইফুল।

সূত্রে জানা যায়, এসকে ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার পরিচয়ে সিআইপি খেতাব পান সাইফুল। এই পরিচয়ের আড়ালে তার মূল কারবার ইয়াবা। চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির ভিআইপি টাওয়ারে রয়েছে তার একাধিক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট। এর কোনো একটিতে তার বাস। রাজধানীতেও তার একাধিক ফ্ল্যাট আছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় লাখ লাখ ইয়াবার চালান পৌঁছে দেয় তার সহযোগীরা। বাসা বা হোটেলে বসে গোপন ফোন নম্বরে লেনদেন তদারকি করেন সাইফুল।

ad

পাঠকের মতামত