348941

প্রচণ্ড চাপে ফরাসি মুসলিমরা

ফ্রান্স ওই দেশে ইমামদের ”প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের সনদ”’ নামে নতুন এক সনদে স্বাক্ষর করার যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে তার বয়ান নিয়ে কথা বলতে ফ্রান্সের মুসলিম কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের এ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে বৈঠকে বসার কথা।

এই সনদে সই করার বিষয়টি ফ্রান্সের মুসলমানদের মধ্যে একটা বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্সের বিশেষ করে উদার মানসিকতার ইমামরা এই সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছেন।

দেশটির নয়টি পৃথক মুসলিম সংগঠনের জোট এই ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব দ্য মুসলিম ফেইথ বা সিএফসিএম ইমামদের নিয়োগ এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইমাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে।

ফ্রান্সে এই সনদ নিয়ে বিতর্ক চললেও ফ্রান্সের সরকার এই সনদ কার্যকর করতে এবং ইমামদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে যে বদ্ধপরিকর তার একটা প্রমাণ ফ্রান্সে পাকিস্তানের এক ইমামের সাম্প্রতিক কারাদণ্ড।

প্যারিসের উত্তর শহরতলীর একজন পাকিস্তানি ইমাম লুকমান হায়দারকে দিনকয়েক আগে, ২৭ নভেম্বর, ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে টিকটক প্ল্যাটফর্মে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উস্কানি দিয়ে ভিডিও বার্তা পোস্ট করার জন্য।

২০১৫ সালে ফ্রান্সে যাওয়া এই ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি টিকটকে তিনটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, যার প্রথমটিতে তিনি শার্লি এবদোতে ইসলামের নবীর কার্টুন ছাপা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “মুসলমানরা নবীর জন্য নিজেদের জীবন কোরবানি করতে প্রস্তুত”। দ্বিতীয়টিতে তিনি “অমুসলিম ও অবিশ্বাসীদের ওপর হামলার” কথা বলেন এবং বলেন “তাদের স্থান দোজখে”। ২৫ সেপ্টেম্বর পোস্ট করা শেষ ভিডিওতে তিনি পাকিস্তানি এক হামলাকারীর শার্লি এবেদোর সাবেক দপ্তরের বাইরে ছুরিকাঘাতে চার ব্যক্তিকে জখম করার “সাহসিকতার” প্রশংসা করেন।

ইমাম লুকমান হায়দারের সাজা খাটা শেষ হলে তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে।

মূল্যবোধের সনদ
ইমামদের যে ”প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের সনদ”-এ স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, সেই সনদের বয়ানে থাকতে হবে যে, ফরাসী মূল্যবোধকে তারা স্বীকৃতি দেন, ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক আন্দোলনের আদর্শ হিসাবে তারা প্রত্যাখান করেন এবং মুসলিম গোষ্ঠীগুলোতে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ও এই বয়ানে নিষিদ্ধ করতে হবে। এই সনদ নিয়ে কী ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বিবিসির প্যারিস সংবাদদাতা লুসি উইলিয়ামসন কথা বলেছেন মুসলিমদের সাথে।

“এই মূল্যবোধের সনদের সবকিছুর সাথে আমরা সকলে একমত নই,” বলেছেন ফ্রান্সের মুসলিম কাউন্সিল সিএফসিএম-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদের রেক্টর শেম্স এডিন হাফিজ। তবে তিনি বলছেন, “ফ্রান্সে ইসলাম ধর্মের জন্য এটা একটা ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণ এবং মুসলিম হিসাবে আমরা একটা বড় দায়িত্বের মুখোমুখি”।

তিনি বলছেন, আট বছর আগে তার চিন্তাভাবনা ছিল অন্যরকম। তিনি বিষয়টা দেখতেন ভিন্ন দৃষ্টিতে।

তখন টলুসে এক হামলা চালিয়েছিল ইসলামপন্থী মোহাম্মদ মেরাহ।

“প্রেসিডেন্ট (সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট) সারকোজি এ নিয়ে কথা বলার জন্য ভোর পাঁচটায় আমার ঘুম ভাঙিয়েছিলেন,” তার মনে আছে। “আমার মনে আছে আমি প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম : ‘তার নাম মোহাম্মদ হতে পারে, কিন্তু সে একজন অপরাধী!’ আমি অপরাধের সাথে আমার ধর্মকে জড়াতে চাইনি। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলেছে। ফ্রান্সে ইমামদের সামনে বড় দায়িত্ব রয়েছে।”

ফরাসি সরকারের পরিকল্পনা হলো সিএফসিএম-কে ফ্রান্সের ইমামদের একটি নথিভুক্ত রেজিস্টার তৈরি করতে হবে। এই তালিকাভুক্ত ইমামদের প্রত্যেককে এই সনদে স্বাক্ষর করতে হবে এবং সনদে সই করলে তবেই তারা ইমাম হিসাবে স্বীকৃতি এবং অনুমতিপত্র পাবেন।

প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ অক্টোবর মাসে মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর ওপর ”ব্যাপক চাপ প্রয়োগের” কথা বলেছেন। কিন্তু ফ্রান্সের জন্য কাজটা কঠিন। কারণ দেশটি নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে গর্ব করে থাকে।

ম্যাক্রঁ বলছেন তিনি রাজনৈতিক ইসলামের বিস্তার বন্ধের চেষ্টা করছেন। তিনি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন না। তিনি এই ধরাণা দিতে চান না যে তিনি কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে আলাদা করে দেখছেন।

ফ্রান্সের মুসলিম গোষ্ঠীগুলোকে ফরাসি সমাজে সম্পৃক্ত করার, তাদের সমাজের অংশ করে নেবার জন্য সাম্প্রতিক কয়েক বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চাপ বাড়ছে। ফ্রান্সে ইউরোপের সর্বাধিক সংখ্যক মুসলিমের বাস। দেশটিতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ লাখ।

ফ্রান্সের মুসলিমদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অলিভিয়ের রয় বলছেন, এই সনদের দুটি সমস্যা রয়েছে। এক হলো বৈষম্য, কারণ এটি শুধু মুসলিমদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি ধর্মপালনের স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে।

”আপনি যে দেশে আছেন ওই দেশের আইন মানতে আপনি অবশ্যই বাধ্য,” তিনি বিবিসিকে বলেন, ”কিন্তু সেই দেশের মূল্যবোধ নিয়ে গর্ব করা আপনার জন্য বাধ্যতামূলক কেন করা হবে? আপনি সমকামী, উভলিঙ্গ অর্থাৎ এলজিবিটিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করতে পারেন না। কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীরা তো সমকামীদের বিয়ে অনুমোদন করে না।”

ফ্যাশান ডিজাইনার ইমান মেসতাউই বলছেন তার ভাষায় যাকে তাকে ”ঘৃণার চোখে দেখেন” তাদের কাছ থেকে তিনি নিয়মিত নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। এরা হলেন কট্টরপন্থী কিছু মুসলমান যারা তার স্কার্ফ বা ওড়নার ডিজাইন নিয়ে সমালোচনা করেন – তারা বলেন, তার ডিজাইন করা স্কার্ফ নারীর চুল পুরোপুরি ঢাকে না।

কিন্তু তিনিও মনে করছেন, ”ফরাসি মূল্যবোধে”র সনদে ইমামদের স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। ফ্রান্সে অনেকেই মুসলিমদের পুরোপুরি ফরাসি হিসেবে মেনে নিতে চায় না।

”দাবিটা খুবই অদ্ভুত। আপনাকে দেখাতে হবে আপনি প্রজাতন্ত্রের মূল্যবোধের সাথে একমত, আপনি নিজেকে দেশটিতে একজন ফরাসি বলে ভাবুন, যেখানে কিন্তু ফরাসিরা আপনাকে ফরাসি বলে মনে করবে না,” তিনি ব্যাখ্যা করলেন।

”আমরা এ দেশে যাই করি না কেন- কর দেয়া থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে অংশ নেয়া – কখনই কিন্তু সেটা যথেষ্ট মনে করা হবে না। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি সত্যিকার অর্থে ফরাসি : আপনাকে শূকরের মাংস খেতে হবে, মদ পান করতে হবে, হিজাব পরতে পারবেন না, উরুর ওপর স্কার্ট পরতে হবে। এটা রীতিমত হাস্যকর।”

কট্টরপন্থা ও ইমামদের ভূমিকা
তবে প্যারিসের উপকণ্ঠে ড্রান্সি মসজিদের ইমাম হাসান শালঘৌমি বলছেন কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির সরকারকে বাধ্য হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। তার সংস্কারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেবার পর থেকে শালঘৌমি এখন লুকিয়ে রয়েছেন।

“আমাদের এখানে বাড়তি করণীয় আছে। আমরা যে ফরাসী সমাজের অংশ সেটা আমাদের প্রমাণ করার একটা ব্যাপার আছে। আমরা যে দেশটির আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেটাও আমাদের দেখাতে হবে,” বলেন শালঘৌমি। “কট্টরপন্থীদের কার্যকলাপের কারণেই আমাদের এই মূল্য দিতে হবে।”

প্যারিসের বড় মসজিদ গ্র্যান্ড মসজিদের বাইরে জায়নামাজ আর কোরআন নিয়ে নামাজ আদায় করতে এসেছেন চারকি দেন্নাই।

”এই কট্টরপন্থী তরুণরা টাইম বোমা,” তার বক্তব্য। “আমার মতে ইমামরা তাদের সাথে খুবই নরম আচরণ করেন। দেখুন আমরা ফরাসী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একইভাবে ইমামকেও আমি শ্রদ্ধা করি। এটা অবশ্যই সম্ভব। আমি তো এটাই করতে চাই।”

কিন্তু ইমামরা তরুণ মুসলমানদের কতটা প্রভাবিত করতে পারেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে যেসব তরুণ কট্টরপন্থী মনোভাবের এবং সহিংস পথের অনুসারী।

“এটা মোটেই কাজ করবে না,” বলছেন অলিভিয়ের রয়, “এর সহজ কারণ হল এরা কিন্তু সালাফি মতবাদে দীক্ষিত হয়নি। আপনি যদি এই সন্ত্রাসীদের জীবন পরিচয় দেখেন দেখবেন রাজনৈতিক ইসলামের ধারার যে মতাদর্শ তারা সেই মতাদর্শের সাথে আদৌ পরিচিত নয়।”

কাজেই তাদের সহিংস পন্থার সাথে ইসলামী শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ অলিভিয়ের রয়।

তরুণ সম্প্রদায়ের জন্য কৌশল
ফ্রান্সের সরকার এই সনদের মাধ্যমে “বিদেশি হস্তক্ষেপ” বন্ধ করার প্রয়াস নিয়েছে। সরকার মনে করছে বিদেশি প্রভাব ঠেকানো, কট্টরপন্থীদের সহিংসতা ও হুমকি প্রতিহত করার জন্য সরকারি কৌশলের একটি অংশ হবে এই সনদ।

সরকার চাইছে যেসব তরুণ মনে করছে রাষ্ট্র তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে এই সনদ কার্যকর করে তাদের সমাজে অন্তর্ভূক্ত করা যাবে।

সরকার তরুণদের হৃদয় জয় করতে আরও কিছু ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছে।

ম্যাক্রঁ সরকারি স্কুলগুলোতে আরবী ভাষা শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে চান, দরিদ্র এলাকাগুলোতে তিনি বিনিয়োগ বাড়াতে চান এবং তিনি জোর দিয়ে বলেছেন তার সংস্কারের লক্ষ্য কট্টরপন্থী মুসলিমরা যারা ফ্রান্সের আইন এবং মূল্যবোধ প্রত্যাখান করছে। তিনি বলেছেন তিনি মুসলমানদের সার্বিকভাবে লক্ষ্যবস্তু করছেন না।

ফ্রান্সে ইসলামপন্থীদের আন্দোলন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ হাকিম আল-কারুনি ফ্রান্সের সরকারকে ইসলাম বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

”কৌশলের ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী,” তিনি বিবিসিকে বলেন। ”এই সরকারি কৌশল খুবই পূর্ণাঙ্গ পরিসরে নেয়া। এখানে সাংস্কৃতিক, এবং সংগঠনের ভূমিকা ও অর্থায়ন বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।”

কিন্তু তিনি বলছেন, এধরনের প্রকল্পে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে সরকারের সম্পৃক্ত করা উচিত, ”কারণ ইসলাম ধর্মের আসল শিক্ষা এবং এই ধর্মের আলো তারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার দক্ষতা এবং যোগ্যতা রাখেন। ফ্রান্সের সরকার কখনও সেটা করতে পারবে না।”

এবং “তৃণমূল স্তরের মুসলিমদের” আস্থা এখানে অর্জন করতে না পারলে এই সনদ কার্যকর করা খুবই কঠিন হবে, বলছেন অলিভিয়ের রয়।

”ধরা যাক, স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অব দ্য মুসলিম ফেইথ বা সিএফসিএম-কে পুরো অগ্রাহ্য করে তাদের নিজস্ব একজন ইমাম নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিল। তখন সরকার কী করবে?” বলছেন অলিভিয়ের রয়।

“সরকারকে হয় সংবিধান বদলাতে হবে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণা বাদ দিতে হবে। নাহলে সরকার কখনই মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর সরকার অনুমোদিত ইমাম নিয়োগের একটা ব্যবস্থা সনদ সই করিয়ে কায়েম করতে পারবে না।”

প্যারিসের ফ্যাশান ডিজাইনার ইমান মেসতাউই বলছিলেন ২০১৭ সালে তিনি তার পরিবারের সকলকে রাজি করিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁকে ভোট দেবার জন্য।

কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে ম্যাক্রঁ কীভাবে অভিবাসন ও নিরাপত্তা ইস্যুতে দক্ষিণ পন্থার দিকে “চরমভাবে ঝুঁকেছেন”।

“আমি ম্যাক্রঁ-পন্থী ছিলাম,” তিনি বলেন। “আমি ভেবেছিলাম আমাদের মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য তিনি সত্যিকার আশা ভরসা। কিন্তু এখন মনে হয় তিনি আমাদের দূরে ঠেলে ব্রাত্য করে দিয়েছেন।”

সূত্র : বিবিসি

ad

পাঠকের মতামত