343106

ভারত কি বাংলাদেশকে সত্যিই ষোলো আনা ফাঁকি দিয়েছে?

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়েছে। বিগত ১০ বছরে এই সম্পর্ক শুধু মৌখিক সম্পর্কের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং উন্নয়ন সহযোগিতায় রূপ নিয়েছে। ২০১০ সালের এলওসি চুক্তির মাধ্যমে এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ভারত বাংলাদেশের অংশীদার হয়। এখন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের তিনটি লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই এলওসির মাধ্যমে যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগী হয়ে উঠছে। কিন্তু সম্প্রতি অনেকেই এই এলওসিকে ষোলো আনাই ফাঁকি বলে বিবৃতি দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পসহ সড়ক-রেল-নৌ-বিমান যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদি খাতে এই এলওসির আওতায় ভারত বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরেও এই প্রশ্নগুলো কেন উত্থাপিত হয়েছে! কেনই বা জেনেবুঝে অনেকেই এই এলওসি নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত! যারা জেনেবুঝে এই অপপ্রচারে শামিল হয়েছেন তাদের উদ্দেশে আমার এই লেখা নয় বরং যারা সেই অর্বাচীন লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রকৃত বিষয়টা জানানোর জন্য আমার এই লেখা। ভারত বাংলাদেশের মাঝে হওয়া এলওসি কতটুকু কার্যকর বা বাস্তবায়ন হয়েছে আর কতটুকু হয়নি এবং কেন হয়নি সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে অনেকের নানামুখী বক্তব্য সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনটি এলওসি স্বাক্ষরিত হয় যার প্রথমটি হয় ২০১০ সালে। সে সময় বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা বাড়ায় দেশটি। এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের এলওসি চুক্তি ও ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের তৃতীয় এলওসি চুক্তি হয়। এই তিন এলওসির মাধ্যমে সবশেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এখন প্রশ্ন ওঠেছে, এর কী পরিমাণ কাজ এখন পর্যন্ত হয়েছে। অনেকেই কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলতে চাইছেন, ঋণচুক্তির পর ১০ বছর পার হলেও ভারত তাদের কথা রাখেনি! কিন্তু এই কথা রাখা বা না রাখার বিষয়টা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যদি আমরা দেখি তবেই পরিষ্কার হবে ভারত আসলেই কি আমাদের ষোলো আনা ফাঁকি দিয়েছে কিনা!

প্রথমেই আসব ২০১০ সালের এলওসির দিকে। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় ভারত। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের সময় ভারত সরকার ওই ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৪ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে অনুদান দেয়। বাকি ৮৬ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি সই হয় পণ্য কেনাকাটা, রেলওয়ে অবকাঠামো নির্মাণ, নদী খনন, সেতু নির্মাণ, বাস, রেলের ইঞ্জিন ও বগি কেনাকাটা এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা সংস্কারের জন্য। চুক্তির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ১২টি শেষ হয়েছে। ৮৬ কোটি ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি ডলার। ২৬ কোটি ডলার এখনো খরচ হয়নি। প্রথম এলওসির এই তিন কাজ সম্পন্ন না হওয়াকে কেন্দ্র করে অনেকেই অনেক বক্তব্য দিচ্ছে কিন্তু কেন সম্পন্ন হয়নি বা কাজের অগ্রগতি কত দূর সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা কেউই অবগত না। বিশেষ করে প্রথম এলওসির অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন খুলনা থেকে মোংলাবন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে জটিলতা এখানে উল্লেখ করতেই হয়। ঠিকাদারের সঙ্গে এই প্রকল্পের চুক্তি হয়েছে ২০১৬ সালে। কারণ, ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যার কারণে প্রকল্প শুরু করা যায়নি। এখন ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ না হলে নিশ্চয়ই ঋণ প্রকল্পের টাকা কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান আগে দিয়ে দেবে না। তার মানে এখানে প্রকল্পের ঋণদাতা দেশের চাইতেও ঋণগ্রহীতা মানে টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা রয়েছে। তা ছাড়া বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা বাকি দুটি অবকাঠামোগত কাজও একটু বিলম্বে শুরু হওয়ার পেছনে একটি বিশেষ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (এশিয়া) জাহিদুল হক। তিনি এক বেসরকারি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই বিলম্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নকশা পরিবর্তনের বিষয়টা। অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোর নকশায় নাকি বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সব অংশীদারের সম্মতি নিতে হয়েছে। এ কারণে সময়মতো নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? প্রকল্পের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে দাতার সমস্যা এখানে মুখ্য না, বরং প্রকল্পের নকশা জটিলতা বা অনুমোদন ও কিছুক্ষেত্রে বাস্তবায়নের ধীরগতি একটা কারণ হতে পারে। তবে এখন কাজ দ্রুতই এগোচ্ছে, আশা করা হচ্ছে আগামী দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।

এবার আসি দ্বিতীয় এলওসির দিকে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি হয়। সে বছরের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফরকালে এই এলওসি চুক্তি ঘোষণা করেন। এই ঋণচুক্তির অধীনে ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব প্রকল্পে রেল, বিদ্যুৎ, সড়ক ও পরিবহন, স্বাস্থ্য ও কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ প্রকল্পে পরামর্শক/কেনাকাটার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এই চুক্তির আওতায় দেড় কোটি ডলার খরচ হয়েছে। এসব প্রকল্পের অনেক বাস্তবায়িত হয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ধীন।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের তৃতীয় এলওসি চুক্তি হয়। সে বছর এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে এই এলওসি চুক্তি হয়। এই এলওসি চুক্তির অধীনে আরও ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই এলওসির অধীনে যে প্রকল্পগুলো পড়েছে তা হলো- পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ অন্যত্র নেওয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, পায়রা বন্দর টার্মিনাল নির্মাণ, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার, সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়ন, বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে নড়াইল-ভাঙ্গা পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, মোংলা বন্দর উন্নয়ন, মিরসরাইতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ঢাকার রাস্তায় এক লাখ এলইডি বাতি সংস্থাপন, মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা এবং বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে ৫টি প্রকল্প আছে টেন্ডারিং পর্যায়ে, বাকি ১১টি প্রকল্প আছে ডিপিপি পর্যায়ে। এ পর্যন্ত এসেছে ১২ লাখ ডলার। এ বছরের এপ্রিলে প্রতিরক্ষা খাতে কেনাকাটার জন্য ৫০ কোটি ডলারের শেষ ঋণচুক্তিটি সই হয়। তবে এর আওতায় কী কী কেনাকাটা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর তাই এই প্রকল্পটিও একটু দেরি হচ্ছে।

এবার আসছি এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কিছুটা ধীরগতির কারণ কি সেই বিষয়ে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ করুন, প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় এলওসির বেশির ভাগ প্রকল্পই ছিল অবকাঠামোগত। এখানে অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয় যা আমাদের অনেকের অজানা। এই ধাপগুলো অতিক্রমের পর কার্যকর পর্যায়ে প্রকল্পকে নিয়ে যেতে হয়। প্রথমত, ভারতের সম্মতি পাওয়ার পর প্রকল্পগুলোর পরামর্শক নিয়োগে যেতে হবে। পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বানের আগে ভারত থেকে দরপত্র দলিলে সম্মতি আদায় করতে হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির আগে ভারতের সম্মতি নিতে হয়। এরপর ভৌতকাজের জন্য দরপত্র দলিল তৈরি করে আবারও সম্মতি আদায়ে হাইকমিশনের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এক্সিম ব্যাংকে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে যতবার দরপত্র দলিল সংশোধন করা হয়, ততবারই ভারতের অনুমোদন নিতে হয়। দরদাতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করার আগেও এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র এক্সিম ব্যাংকে পাঠাতে হবে। এভাবে প্রতিটি অনুমোদনে দুই থেকে চার বছর সময় লাগে।

আবার প্রথম এলওসির বেশ কিছু কয়েকটি প্রকল্প ধীরগতির হয়েছে কারণ ২০১০ সালের আগস্টে প্রথম চুক্তিটি সই হয়েছিল প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার আগেই। তাই প্রকল্প চূড়ান্ত করা আর ভারত থেকে কেনাকাটার শর্ত শিথিল করা—এ দুটি বিষয় সুরাহা করতে দেরি হয়েছিল। তা ছাড়া প্রকল্প ছাড়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সরাসরি ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে যাওয়ায় অতিরিক্ত সময় লেগেছিল।

তাই যারা দাবি করছেন, ‘বাংলাদেশকে ১৬ আনাই ফাঁকি দিয়েছে ভারত’- তাদের আগে জানতে হবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে জটিলতাসমূহ। জানতে হবে, প্রকল্পের জায়গা অধিগ্রহণ বা নকশা ঠিক না থাকলে কখনোই প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ আগে এসে আপনার ঘরে বসে থাকবে না। বরং অবকাঠামোগত এসব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক সূক্ষ্মভাবে এই জটিল ধাপগুলো পাড়ি দিয়ে একটি প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করতে হয়। ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতির এক বছরের মাথায় যদি আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখতে চাই তবে সেটা হবে আকাশকুসুম কল্পনা। তাই এলওসির সার্বিক বিষয় জেনেবুঝেই আমাদের সবার বক্তব্য দেয়া উচিত। আমরা আশা রাখব, এমন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি যেন দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে না আসে যা দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে, ‘গণভবন’ ও ‘জনপথ রোড’ এর সম্পর্ক ঐতিহাসিক, চিরঞ্জীব এবং শাশ্বত।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

সূত্রঃ সময় টিভি

ad

পাঠকের মতামত