340597

‘বিরোধী দলহীন’ মাঠে নুরই প্রতিপক্ষ!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরস আলোচনা আছে—মা’রধ’রের মাধ্যমেই নুরুল হক নুরকে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। আর বর্তমান সময়ে রাজনীতির মাঠে বিরোধী দল বলতে কার্যত কেউ না থাকায় নুরের কার্যক্রমকেই ক্ষমতাসীনরা বিরোধী তৎপরতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

ছাত্র অধিকার আদায়কে পুঁজি করে তরুণদের মাঝে জনপ্রিয়তা পান নুরুল হক নুর। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে দফায় দফায় লাঞ্ছিত ও হামলার শিকার হন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত বছর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর জনপ্রিয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি পরাজিত করেন ছাত্রলীগের সভাপতিকে।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুতে ভিপি নুরের মেয়াদ শেষ। তিনি এবার মনোযোগ দিয়েছেন নতুন রাজনৈতিক দল গড়ায়। ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার আদায় ও জাতীয় ইস্যুতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে বক্তব্যও দিচ্ছেন। দল গড়ার অংশ হিসেবে শ্রমিক, যুবক, ছাত্র ও প্রবাসীদের নিয়ে পৃথক পৃথক অধিকার পরিষদ গড়ে তুলেছেন। ‘জনতার অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার’ স্লোগানে এ বছরের মধ্যেই নতুন দল ঘোষণা করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

তবে এই আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে নুরের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাদ সেধেছে নতুন নতুন মা’মলা। এখন তাঁর ঘাড়ে ঝু’লছে ছয়টি মা’মলা। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তাঁকে ধ’র্ষ’ণের ঘটনায় করা মা’মলায় নুরকে সহায়তার আ’সামি করেন। এরপর ওই রাতেই পুলিশ তাঁকে দুবার আ’টক করে ছেড়ে দেয়। ওই ছাত্রী গতকাল মঙ্গলবার অ’প’হরণ, ধ’র্ষণ ও ডিজিটাল আইনে নুরসহ কোটা আন্দোলনের ছয়জনের বি’রু’দ্ধে আরেকটি মা’মলা করেছেন। নুরের বি’রু’দ্ধে আগের মা’মলাগুলো হয়েছে ডাকসুর নির্বাচনে ব্যালট ছি’নতা’ই, মোবাইল চু’রি, মানহানি ও ধর্মীয় উ’সকানি দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবনতি ঘটাতে গু’জব ছড়ানোর অ’ভিযোগে। এসব ঘটনায় নুরের সংগঠনের অ’ভিযোগ জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে বিশেষ শক্তির ইঙ্গিতে তার ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে এসব মিথ্যা অ’ভিযোগ তোলা হচ্ছে। তবে এমনও বলা হচ্ছে, এসব করে নুরের জনপ্রিয়তাই বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর শক্তি কতখানি তার বিশ্লেষণও চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নুররা কোটা সংস্কার চেয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলায় পিছু হটে সরকার। দাবি মেনে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা উঠে গেছে। পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চেয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মানতে বাধ্য হয় সরকার, যাতে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন নুর। তরুণদের নিয়ে নুরের রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা নিয়ে তাই অনেকের মনে কৌতূহল ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপি বড় দল হলেও হা’মলা-মা’মলায় এখন পর্যুদস্ত। প্রকাশ্য কর্মসূচিতে নেই তারা। তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তরুণদের নিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন নুর। তরুণদের সংগঠিত করে বড় আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তাঁরা। ঢাকা-১৮ ও ৫ আসনে উপনির্বাচনে এমপি প্রার্থী হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। বিরোধী দলহীন রাজনীতির মাঠে তাই মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছেন নুর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নুরুল হক নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় ছাত্রলীগের একাধিপত্য খর্ব হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের যাঁরা ছাত্রলীগে যুক্ত ছিলেন না তাঁদের অনেকেই নুরের সঙ্গে যোগ দেন। বিভিন্ন ঘটনায় জোরালো মত ব্যক্ত করায় আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় ভিপি নুর হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ।

ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ছাত্রলীগের দফায় দফায় হা’মলা ও মিডিয়ার সামনে এনে গুরুত্বপূর্ণ বানানো হয়েছে। যতবার মা’র খে’য়েছেন ততবারই ‘হিরো’ হয়েছেন নুর। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ২৫টি আসনের মধ্যে ২৩টিতে জিতলেও ভিপি পদে নুরকে হারাতে পারেনি। তাঁরা বলেন, ‘মা’রধ’রের মাধ্যমে নুরকে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় করা হয়েছে। এখন হা’মলা-মা’মলা করে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন তরুণদের একটি অংশকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়া তেমন বড় কোনো অর্জন নেই নুরের। ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হলেও সে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়।’

নুর বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় ছাত্রলীগ আমার বি’রু’দ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তরুণদের সংগঠিত করায় ক্ষি’প্ত হয়েছে। ছাত্র আ’ন্দোলনকে সরকার ভ’য় পাওয়ায় মা’মলা ও হা’মলা দিয়ে দ’মিয়ে রাখতে চাইছে। তবে ছাত্রদের দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সরকার পিছু হটেছে।’ নুর জানান, ভিপি হওয়ার পর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলে আটবার এবং ভিপি হওয়ার আগে তিনবার তিনি হা’মলার শি’কার হন। প্রতিটি হা’মলার পেছনে নেতৃত্ব দিয়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ। কোনোটিরই বিচার হয়নি।

নুরের বি’রু’দ্ধে যত মা’মলা : ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে রোকেয়া হলের ব্যালট ছি’নতা’ই ও প্রাধ্যক্ষকে লা’ঞ্ছিত করার অ’ভিযোগ তুলে নুর ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীসহ ৪০ জনের বি’রু’দ্ধে মা’মলা করা হয়। অধিকার খর্ব হওয়ার ১১ মার্চ নৃত্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মারজুকা রায়না বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মা’মলা করেন।

এরপর ১০ ডিসেম্বর নুরের বি’রু’দ্ধে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেলে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে নির্বাচিত ভিপি মোজাহিদ কামাল মা’মলা করেন। এক আত্মীয়কে টেন্ডার পাইয়ে দিতে মুঠোফোনে এক ব্যক্তির সঙ্গে নুরের কথোপকথনের সূত্র ধরে তাঁর বি’রু’দ্ধে টে’ন্ডারবা’জি, চাঁ’দাবা’জি, অনৈতিক সুপারিশ ও তদবির বাণিজ্যের অ’ভিযোগ তোলা হয়।

২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনে হা’মলার শি’কার হয় নুরুল হক নুর। ওই সময় ভিপি নুরের বি’রু’দ্ধে হ’ত্যাচে’ষ্টা, মানিব্যাগ ছি’নতা’ই ও মোবাইল ফোন চু’রির অ’ভিযোগে শাহবাগ থানায় মা’মলা করা হয়। মা’মলা করে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখার সাবেক সহসভাপতি ডি এম সাব্বির হোসাইন।

২৮ ডিসেম্বর ধর্মীয় উ’সকানি ও অ’প্রচারের অ’ভিযোগে ডিজিটাল সিকিউরিটিজ আ’ইনে নুরের বি’রু’দ্ধে মা’মলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাসের বি’রু’দ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য এবং গু’জব ছড়ানোর অ’ভিযোগে ধানমণ্ডি থানায় এই মা’মলা করেন জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী অর্ণব হোড়।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হা’মলার ঘ’টনা ঘটে। ওই ঘট’নায় নুরকেও আ’সামি করা হয়।

নুরুল হক নুর বলেন, ‘প্রতিটি মা’মলা ভিত্তিহীন। এসব মা’মলা পলিটিক্যাল মটিভেটেড। আমাদের নিয়ে একটি মত তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই মত দ’মানো ও কোণঠাসার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা কারো শত্রু নই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। তারা টাকার অফার দিয়েছে, কেনার চেষ্টা করেছে; কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় হা’মলা-মা’মলার মাধ্যমে দ’মানোর চেষ্টা করছে।’ রাজনৈতিক হ’য়রানির উদ্দেশ্যে ক্ষ’মতাসীন দল ‘মিথ্যা মা’মলা দিয়ে হ’য়রানি করছে নুরের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ঘটনা-ই না। কিছু মানুষ নিজের গা’য়ে আ’গুন দিয়ে অন্যকে দোষারোপ করে, নুরের অবস্থাও তাই-ই। তাঁকে মি’থ্যা মা’মলা দিয়ে হ’য়রানি করার কোনো বিষয় নেই। বরং সে বিদেশি এজেন্টদের পক্ষ হয়ে কথা বলছে। বিদেশি ষ’ড়যন্ত্র’কারীদের পক্ষে নানা কথা বলছে। বাচ্চা ছেলে তো, রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যা ইচ্ছা তা-ই বলছে। এখন তো ভিপিগিরি নেই, দু-বছর পর তাকে বাটি চালান দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ সূত্রঃ কালের কন্ঠ

 

ad

পাঠকের মতামত