306895

আদালতে নির্বাক সু চি, নির্বিচার হ’ত্যাকাণ্ড বন্ধ চায় গাম্বিয়া

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ গণহ’ত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দায়েরকৃত মামলার শুনানির শুরুতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বোধ হ’ত্যাকাণ্ড বন্ধে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টার দিকে এ মামলার শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, গাম্বিয়া যা বলছে তা হলো আপনি মিয়ানমারকে এই নির্বোধ হ’ত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বলুন।

দ্য হেগে রোহিঙ্গা গণহ’ত্যার এ বিচারপ্রক্রিয়ায় দেশের হয়ে আইনি লড়াই চালাতে আদালতে উপস্থিত রয়েছেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি। গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামাবাদু।

মামলার শুনানির শুরুতে তিনি বলেন, বর্বর এবং নৃশংস এসব কাজ; যা আমাদের সবার বিবেককে আঘাত করেছে। এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। নিজ দেশের মানুষকে গণহ’ত্যা বন্ধ করতে হবে।

হেগের আদালতে এ মামলার শুনানি চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মামলায় গণহ’ত্যার দায় অস্বীকারের পক্ষে সাফাই গাইতে লড়ছেন অং সান সু চি। দ্য হেগের শান্তি প্রাসাদে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টার আগে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে পৌঁছান মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় এ উপদেষ্টা।

শুনানির শুরুতে এ মামলার প্রধান বিচারপতি আব্দুল কাই আহমেদ ইউসুফ অভিযোগ পড়ে শোনান। সোমালীয় বংশোদ্ভূত এই বিচারপতি পরে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের পক্ষে একজন করে অ্যাডহক বিচারক নিয়োগ দেন। দুই অ্যাডহক বিচারপতি গাম্বিয়ার নাভি পিল্লাই এবং মিয়ানমারের প্রফেসর ক্লাউস ক্রেস। তারা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার শুরুতে শপথ নেন।

আইসিজের রেজিস্ট্রার ফিলিপ গোতিয়ে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গাম্বিয়ার করা এক আবেদনের বিস্তারিত পড়ে শোনান। পরে অধ্যাপক পায়াম আখাভান রাখাইনে গণহ’ত্যার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার জাতিসংঘের গণহ’ত্যা সনদের ৭০তম বার্ষিকী। কিন্তু এ সনদের শর্ত অনুযায়ী গণ’হ’ত্যা বন্ধ করেনি মিয়ানমার।

নির্বিকার সু চি-আদালত কক্ষে গাম্বিয়ার আইনজীবী দলের সদস্যরা যখন মিয়ানমারের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেন তখন নির্বিকার দেখা যায় অং সান সু চিকে। এ সময় আদালতের বাইরে কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে ন্যায়বিচারের দাবিতে সমাবেশ করতে দেখা যায়।

একই সময়ে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত ইয়াঙ্গুনে সু চির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে। সমাবেশে আসা বার্মিজদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। অনেকেই ‘দেশের মর্যাদা রক্ষায়’, ‘জননী সু চির পাশে দাঁড়ান’ স্লোগান দেন।

যেভাবে আইসিজেতে রোহিঙ্গা গণহ’ত্যার মামলা-জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে রোহিঙ্গা গণহ’ত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে গাম্বিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক এ আদালতে গণহ’ত্যার দায়ে তৃতীয় মামলা এটি।

গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে শুধু গণহ’ত্যা থেকে বিরত থাকা নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য দেশগুলো বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে প্রথম জেনোসাইড কনভেনশন মামলা হয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে। এই মামলায় সার্বিয়া বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়ায় গণহ’ত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল বলে প্রমাণ হয়।

কানাডা, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, তুরস্ক এবং ফ্রান্স জোর দিয়ে বলেছে যে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার গণহ’ত্যা চালিয়েছে। ইসলামী দেশসমূহের সংগঠন ওআইসি তার ৫৭টি সদস্য দেশকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কাজে সহায়তা করে।

যেভাবে মামলার তদন্ত-গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রাথমিক তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।চলতি বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর ৪ জুলাই রোহিঙ্গাদের ওপর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির অনুমতি চান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা। জুলাই মাসে তার তদন্ত দল বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে।

এরপর প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করেন ফাতো বেনসুদা যাতে সায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা। ফলে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের ঘটনায় কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে তদন্ত শুরু হয়।

তবে শুরুর দিকে অনেকে এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয়। একইভাবে আইসিসির প্রতিনিধি দলকেও রাখাইনে পরিদর্শনে যাওয়ার অনুমতিও দেয়নি।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এই অভিযান গণহ’ত্যার অভিপ্রায়ে পরিচালনা করেছে বলে মন্তব্য করেছে।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি।

ad

পাঠকের মতামত