354518

রমজানের পরিকল্পনা শুরু হোক এখন থেকেই

ইসলামিক ডেস্ক: আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান। পশ্চিমাকাশে রমজানের চাঁদ উদিত হলেই আরম্ভ হবে এই মহিমান্বিত মাস। এমাসে প্রত্যেক বালেগ ও সক্ষম মুসলিম নারী-পুরুষের উপর রোজা রাখা ফরজ।

মহান আল্লাহ বলেন- “তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। -সূরা বাকারা-১৮৫।

কুরআনুল কারিম ও সহীহ হাদীসে এ মাসের অনেক ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। এই মাসের যথাযোগ্য মর্যাদা দান ও এর থেকে পূর্ণাঙ্গ ফায়দা অর্জনের জন্য চাই যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি। রাসূলুল্লাহ (সা.) রজব মাসের শুরু থেকেই রমজানের জন্য নিজে প্রস্তুতি নিতেন এবং সাহাবাদেরও প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিতেন।

মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ: রমজান মাসের প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান মাস থেকেই নফল রোজা রাখা। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)কে রমজান মাসের রোজা ছাড়া অন্য কোনো মাসের রোজা এত অধিক গুরুত্বসহকারে পালন করতে দেখিনি এবং শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে অধিক পরিমাণে রোজা পালন করতে দেখিনি।’ – বুখারি : ১৮৬৮; মুসলিম :১১৫৬।

পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পূর্বের সুন্নত নামাজ যেমন ফরজ নামাজ আদায়ের জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ, মনকে নামাজের জন্য প্রস্তুত করে এবং উৎসাহিত করে, তেমনি শাবান মাসের রোজা রমজান মাসের রোজা পালনে মন ও শরীরকে প্রস্তুত করে এবং উৎসাহিত করে।

বেশি বেশি দোয়া করা: মুসলিম বান্দা তার রবের কাছে বেশি বেশি দোয়া করবে যাতে তিনি তাকে রমজান মাস পাওয়ার তাওফিক দান করেন, ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং শারীরিকভাবে সুস্থ রাখেন, সর্বদা যেন তার আনুগত্য করার এবং তার হুকুম মতো আমল করার তাওফিক দান করেন।

হাদিস শরীফে এসেছে, রজব মাস এলে নবীজি (সা.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করে বলতেন, হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন আর রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের জীবন দান করুন।’ -বায়হাকি, শুআবুল ইমান ৩৭৫।

রমজানের আগমনে আনন্দিত হওয়া: রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতগুলোর অন্যতম একটি। কারণ এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। রমজান মাস হলো কুরআনের মাস। এ মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। তাই এ মাসের আগমনে মনে খুশি ও আনন্দ অনুভব করা।

ওয়াজিব রোজার কাজা আদায় করা: বিগত রমজানে অসুস্থতা বা সফরের কারণে কোনো রোজা কাজা হয়ে থাকলে, সেসব রোজা আদায় করে নিজেকে মুক্ত করে ফেলা।

এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু সালামাহ (রা.) বলেন, আমি হযরত আয়েশাকে (রা.) বলতে শুনেছি, ‘আমার ওপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকত, যার কাজা আমি শাবান মাসের পরে আদায় করতে পারতাম না।’- বুখারি : ১৮৪৯; মুসলিম : ১১৪৬।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, ‘হজরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস প্রমাণ করে যে, এক রমজানের অনাদায় রোজা পরের রমজান আসা পর্যন্ত বিলম্ব করা জায়েজ নেই। অর্থাৎ এক রমজানের কাজা রোজা পরবর্তী রমজান আসার পূর্বেই আদায় করতে হবে।’ -ফতহুল বারি : ৪/১৯১।

বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা: হযরত সালামাহ ইবনে কুহাইল (রা.) বলেন, শাবান মাসকে কারীদের মাস বলা হতো। হযরত আমর ইবনে কাইস (রা.) শাবান মাস শুরু হলে তার দোকান বন্ধ করে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর গ্রহণ করতেন। তাই রমজান মাসে বেশি বেশি কুরআন পাঠের প্রস্তুতিস্বরূপ এখন থেকেই কুরআন তেলাওয়াত করার অভ্যাস করা।

এখন থেকে নিয়ত বা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আল্লাহ যদি সুস্থ রাখেন এবারের রমজানের সকল রোজা পরিপূর্ণভাবে রাখবো। রমজানের রোজা পালনে কোনরূপ অলসতা করব না। পূর্ণ আন্তরিকতা ও যাবতীয় শর্তাবলী মেনে চলেই সকল রোজা পালন করব।

রোজা ফরজ হয়েছে পরিবারের এমন প্রত্যেক সদস্যকে রোজা পালনে উৎসাহিত করতে হবে। ছোটদেরকেও দুয়েকটি রোজা রাখিয়ে অথবা সেহরি ইফতারিতে শামিল করিয়ে রোজার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের মাসে কয়েকটি নফল রোজা রেখে অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে।

এছাড়াও রমজান আসার আগেই রোজা সম্পর্কিত মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা জরুরি। এ মাসে গরিব ও অসহায়দের মাঝে বেশি বেশি করে দান-সদকা করতে হবে। কেননা এমাসে দান-সাদকার সওয়াব অন্য মাসের চেয়ে বহুগুণে বেশি পাওয়া যায়।

ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত নামাজের পাশাপাশি নিয়মিত নফল নামাজও পড়ার চেষ্টা করতে হবে। কেননা এ মাসে নফল নামাজের সওয়াব অন্য মাসে ফরজ নামাজের সমতুল্য। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেন মসজিদে জামায়াতের সাথে আদায় করা হয়, সে ব্যাপারে সক্রিয় থাকতে হবে।

যিকির আজকার এ মাসে তুলনামূলক বেশি করতে হবে। চলতে-ফিরতে, উঠা-বসায় সর্বদা আল্লাহর স্বরণে শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় যিকির আজকার করা হবে। প্রত্যেক নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াতের পর দোয়া-দরুদ পড়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করা হবে। নিজের দুঃখ-কষ্ট ও আশা-আকাঙ্খা মহান আল্লাহর সমীপে তুলে ধরতে হবে।

শবে কদরের ফজিলত লাভে রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতে চাইলে এখন থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে, তাদেরকে এখন থেকে যাকাতের হিসাব করে নিতে হবে এবং শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় ও খাতে তা আদায়ের পরিকল্পনা নিতে হবে।

শারীরিক, মানসিক পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ব্যবহারিক কাপড়-চোপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখতে হবে। মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি দাওয়াত দিতে হবে এবং সৎ কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। যারা রোজার ব্যাপারে উদাসীন তাদের মাঝে রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরতে হবে।

রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করে এমন কাজকর্ম থেকে মানুষকে বিরত রাখতে চেষ্টা করতে হবে। অন্যের চেয়ে বেশি পরিমাণে ইবাদত করা চেষ্টা করতে হবে। ইসলাম ও ইবাদতের প্রতি আকৃষ্ট করতে অপরকে ইসলামী বই উপহার দেয়া যেতে পারে।

অশ্লীল, অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী কথা,কাজ ও চিন্তা-ভাবনা পরিহার করতে হবে। রমজানে বেশি বেশি করে আত্ম-সমালোচনা করা হবে। যেন ভুল-ত্রুটিগুলো দূর করার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা যায়।

রমজান যেহেতু ইবাদতের মাস সেহেতু পূর্ণ মনোযোগের সাথে ইবাদত করতে হবে এবং দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে আনতে হবে। ভারি ও কম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো রমজানের আগে অথবা পরে সেরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

রমজানের প্রত্যেক রোজা এবং আমল যেন শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় পালন করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোজা যেহেতু শারীরিক ইবাদত, সেহেতু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। অতি ভোজন ও সময়মত না খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করতে হবে। খাদ্যের অপচয় ও কৃপণতা রোধ করতে হবে। সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে।

তারাবির নামাজ একটি বরকতময় ইবাদত। তাই প্রতিদিন যেন তা পূর্ণভাবে আদায় করা হয়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। সাহরি খাওয়ার পূর্বমুহূর্তে নিয়মিত অথবা মাঝেমধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের চেষ্টা করা হবে।

নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে নফসের দাসত্ব থেকে ফিরিয়ে আল্লাহর দাসত্বের অনুগামী করা।

এভাবে পরিকল্পনার আলোকে যদি আমরা মাহে রমজান মাস অতিবাহিত করতে পারি তাহলেই এই মাসের পরিপূর্ণ হক আদায় হবে এবং রোজার প্রকৃত ফজিলত অর্জিত হবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুক। মুহাদ্দিস : খাদিমুল ইসলাম মাদরাসা, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা।

 

ad

পাঠকের মতামত