353123

দেশে মদপানে কেন বাড়ছে মৃত্যু

নিউজ ডেস্ক।। একত্রিশ জানুয়ারির মধ্যরাত। বগুড়া শহরের তিনমাথা এলাকায় ঋষি (মুচি) পরিবারের ছেলে চঞ্চলের বিয়ের অনুষ্ঠান। চলছে আমন্ত্রিতদের হই-হুল্লোড়। অতি উৎসাহীরা পার্শ্ববর্তী এক হোমিও দোকান থেকে কিনে নিয়ে এলেন অ্যালকোহল।

পানাহারের পর বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন একই পরিবারের রামনাথ, প্রেমনাথ, সুমন রবিদাস ও রবিনাথ। ভোরে অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, সুমন মারা গেছে।

সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সুমনই শুধু নয়, সেই রাতেই অতিরিক্ত অ্যালকোহল ও মদপানে বগুড়া শহরের পুরান বগুড়া, ভবেরবাজার, কাটনাপাড়া ও ফুলবাড়ীতে পৃথক মদপানের ঘটনায় মোট ৬ জনের মৃত্যু হয়। সুমন ছাড়া মৃত অন্য ৫ জন হলেন- ভবেরবাজারের হোটেল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন, পুরান বগুড়া এলাকার রাজমিস্ত্রি রমজান আলী, কাটনারপাড়ার শ্রমিক সাজু মিয়া, বাবুর্চি মোজাহার আলী ও ফুলবাড়ীর শ্রমিক পলাশ। তাদের মধ্যে রমজান ও আলমগীর তাদের বাড়িতেই মারা যান। মদপানে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বগুড়া সদরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ূন কবির।

এ তো গেল বগুড়ার কথা। শুধু এ শহরেই নয়, সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মদপানে মৃত্যু বেড়েই চলছে। বছরের প্রথম মাসেই মদপানে মৃত্যু হয়েছে অর্ধশতাধিক নারী, পুরুষ ও কিশোরের। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। বেশিরভাগ মৃত্যুর ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিষাক্ত ছাড়াও অতিরিক্ত মদপানকে দায়ী করা হচ্ছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, করোনার কারণে বিদেশি মদের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিদেশি মদ বলে হাতে তৈরি মদ বিক্রি করছে। এ ধরনের মদই মৃত্যুর প্রধান কারণ হতে পারে বলে তারা মনে করছেন।

গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ‘ব্যাম্বু স্যুট’ রেস্টুরেন্টে মদপান করেন পাঁচ বন্ধু। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারাহ চৌধুরী ও তার বন্ধু আরাফাত। তাদের মধ্যে শুক্রবার হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরাফাতের। তাদের আরেক বন্ধু অসিম খান ঘটনার পরদিন ফারাহকে প্রথমে ইবনে সিনা ও পরে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

দুদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত রবিবার মারা যান ওই শিক্ষার্থী। ফারাহ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বলছে, মেয়েটির মৃত্যুর আগে রাতে তাকে অতিরিক্ত মদপান করিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক বলছেন- ধর্ষণ নয়, অতিরিক্ত মদপানেই মৃত্যু হয়েছে ফারাহর। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর ক্যান্টনম্যান্ট থানাধীন ডিইউএইচএস-এ আবদুল আল মামুন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত মদপানে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাহান হক। এর আগে গত রবিবার সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার দুই কর্মী শিহাব জহির ও মীর কায়সার। তাদের মৃত্যুর পেছনেও দায়ী অতিরিক্ত মদপান। এ ছাড়া ওই ঘটনায় অসুস্থ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মী। গত শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির ৪৩ কর্মী গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে যায়। সেখানে কর্মীরা মদ পানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ঢাকার কোনো বারে মদ না পেয়ে তারা গাজীপুরে গিয়ে স্থানীয় একজনকে দিয়ে মদ কিনে আনান। মদ খেয়ে ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িতেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। যদিও শেরেবাংলা থানার ওসি জানে আলম মুন্সী জানান, এ বিষয়ে অবগত নন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় আমাদের সময়কে বলেন, আমরা বারিধারা (ডিওএইচএস) ও ভাটারার মদপানে মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে দেখছি। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু মদের বোতল ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের ধারণা বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সেটাও যথাযথ তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। যারা এমন মদ বিক্রি করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।

থার্টিফার্স্ট নাইট উৎযাপন উপলক্ষে ১ জানুয়ারি রাতে রাজশাহীর হোসনীগঞ্জ এলাকায় মদ পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন কয়েকজন। এদের মধ্যে ৫ জন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান ২ জানুয়ারি। মৃতরা হলেন- ফয়সাল, সজল, সাগর, তুহিন ও মুন আহম্মেদ। এ ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আরও কয়েকজন। রাজশাহীতে মদপানে ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৩ জানুয়ারি চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, গ্রেপ্তারদের কাছে মদের খালি বোতল, এক বোতল টিউনিং মদ (মিশ্রিত মদ) তৈরির তরল পদার্থ, কমলা কালারের ৫০ গ্রাম গুঁড়ো রং, ২৯টি টিন ও প্লাস্টিকের তৈরি কর্ক, ১১টি কর্কের নিব ও ৫০টি কর্কের প্রটেকশন ও দুই বোতল এলকোহল উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে জানায়, অতিরিক্ত লাভের আশায় বিদেশি মদের সঙ্গে রেক্টিফাইড স্পিরিটসহ অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে তারা মদ তৈরি করে। যা তারা ককটেল নামে বিক্রি করত। মিশ্রিত এ বিষাক্ত মদ থার্টিফার্স্ট নাইটে পনেরো থেকে ২০ ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছিল।

বগুড়ায় ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবীর বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের পরিবার থেকে বিষাক্ত মদপানে মারা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে অনুসন্ধান চলছে।

গত ৯ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মদপানে অসুস্থ হয়ে ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন- উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদ হাসান বাবু, বাবুর বন্ধু তোফাজ্জল হোসেন, ছাত্রলীগ কর্মী মহসিন মিয়া ও নাহিদ হাসান জিসান। এ ঘটনায় অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন আরও ৬ জন।

সোনারগাঁও থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৭ জানুয়ারি রাতে মৃতরা একসঙ্গে মদপান করে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় পরদিন রাতে ঢাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা গেছে, তোফাজ্জল কোথাও থেকে মদ কিনে আনেন। পরে সবাইকে নিয়ে পান করেন। ধারণা করা যাচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত অথবা বিষাক্ত মদে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

 

ad

পাঠকের মতামত