341161

নেপালের সৈন্যরা কেন ভারতের পক্ষে যু’দ্ধ করবে?

পলাশির যু’দ্ধ ছিল ভারতে উপনিবেশিকতার শুরু। এই যু’দ্ধ আধুনিক ভারতকে এই শিক্ষা দেয় যে, কিভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে পরের ২০০ বছর ভারত শাসন করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মধ্যে এখনো ঔপনিবেশিকতার ভূত হানা দেয়।

ব্রিটিশরা যে কৌশল ব্যবহার করেছিল, ১৯৪৭ সালের পরে ভারতে সেটাই একটা অস্ত্র হয়ে ওঠে। নেপাল এখানে ভুক্তভোগী হয়েছে, কিন্তু ভারত আর ব্রিটেন বলেছে যে, নেপালের উচিত ১৯৪৭ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মেনে চলা, তা তাদের সাথে যে ধরণের আচরণই করা হোক না কেন। ওই চুক্তির অধীনে নেপালের যুবকরা দুই দেশের সামরিক বাহিনীতে কাজ করবে।

প্রতিবেশী দেশগুলোতে অস্থিরতা তৈরি করে আঞ্চলিক আধিপত্য বজায় রাখার যে ঘৃণ্য কৌশল ব্যবহার করে এসেছে ভারত, সেটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় ধরণের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

ভারত আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর একটা কারণ তাদের আধিপত্যবাদী রাজনীতি, আরেকটি কারণ হলো চীনের উত্থান। নেপালের উপর দুইবার অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে ভারত, মাওবাদীদের বিদ্রোহে মদদ দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছে, নেপাল চীনের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের উপর বল প্রয়োগ করেছে, এবং উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদেরকে অনুন্নত রেখে দিয়েছে।

এর উপর ভারত আবার আশা করে যে, তাদের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতায় অংশ নেয়ার জন্য নেপাল তাদের যুবকদের পাঠাবে। ব্রিটিশ রাজের সাথে সম্পর্ক থেকে নেপাল যদি কিছু শিখে থাকে, তাহলে আমাদের বর্তমান নেতাদের প্রশ্ন তোলা উচিত যে, দেশের অভিজাত সেনারা কেন ভারতের পক্ষে যু’দ্ধ করবে, যে দিশটি নেপালকে তাদের সমপর্যায়ের মনে করে না।

৭৩ বছরের পুরনো চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সামরিক বাহিনীতে ছয় রেজিমেন্টে গুর্খা সেনা গেছে, যেখানে নেপালের যুবকেরা ভারতের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পরে এগারোটি গুর্খা রাইফেল গড়ে তোলা হয় এবং এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাতটি রেজিমেন্টে ৩৯টি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে।

ভারতের বড় বড় যু’দ্ধগুলোতে গুর্খা রেজিমেন্ট অংশ নিয়েছে – ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাকিস্তান যু’দ্ধ, সিলেটের যু’দ্ধ, ১৯৬২ সালের সিনো-ভারতীয় যু’দ্ধ সবখানেই ছিল তারা। ভারত যেন ভুলে না যায় যে, ১৯৬২ সালের ইন্দো-চীন যু’দ্ধে নেপালের গুর্খা সেনারাই গালওয়ান উপত্যকা রক্ষা করেছিল।

ভারতের সীমান্ত ও স্বার্থ রক্ষায় নেপালের সর্বোচ্চ সামরিক অবদান থাকার পরও ভারত নেপালের সাথে চরম খারাপ আচরণ করেছে এবং এমনকি নেপালের ভূখণ্ডও দখল করেছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায় ৩০,০০০ নেপালি গুর্খা সেনা কাজ করছে, যেখান থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার আসে নেপালে, আর সেই সাথে পেনশান আসে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু নেপাল আর কতদিন রেমিটেন্সের উপর নির্ভর করে থাকবে আর নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে থাকবে?

ব্রিটেন এখন আর আগের পরাশক্তি নেই এবং এখন মূলত তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে। ১৯৪৭ সালের পরবর্তীকালে ব্রিটেনের গঠন করা চারটি রেজিমেন্টে কাজ করেছে গুর্খারা।

১৮১৪-১৬ সালের ইঙ্গ-নেপাল যু’দ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রুত গুর্খা সেনাদের বীরত্ব আর সাহসিকতা টের পেয়েছিল। তখন থেকেই ব্রিটিশ রাজ সফলভাবে নেপালি যুবকদের প্রলুব্ধ করেছে এবং নিজেদের যু’দ্ধ বিজয়ের জন্য তাদেরকে ব্যবহার করে এসেছে।

দ্রুত পরিবর্তনশীল বহুমেরুর বিশ্বে এই দ্বিমুখী আচরণের অর্থ হলো নেপালের আর টাকার জন্য তরুণদের বিক্রি করে দেয়া উচিত হবে না। ব্রিটেনের সাথে চীনের মতো অন্যান্য উদীয়মান শক্তির সঙ্ঘাতের কারণেও নেপাল জটিল সমস্যায় পড়ে গেছে, কারণ চীন তাদের কাছের প্রতিবেশী এবং সম্প্রতিকালে দুই দেশের সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে।

নেপাল আর চীন যদি পিপলস লিবারেশান আর্মির জন্য গুর্খা রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ভারতের আচরণটা কেমন হবে? ভারত প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করবে এবং নেপালের সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ না করার যে নীতি রয়েছে ভারতের, সেটা শেষ হয়ে যাবে।

নেপাল এখন আর ভারতের মনোভাবের উপর বিশ্বাস রাখতে পারে না বা চীনা বিনিময়ের ব্যাপারেও ঢিলেমি করতে পারে না। ইতিহাস নেপালকে এটা শিখিয়েছে যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা যারা দেবে, তাদের সাথেই কেবল মিত্রতা করতে পারে নেপালের অভিজাত বাহিনী। ভবিষ্যতের এর পার্থক্য খুব একটা হবে না।

সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড

ad

পাঠকের মতামত