372063

২০২৬ সালের শুরুতেই আসছে নবম পে স্কেল, সুখবর সরকারি চাকরিজীবীদের

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত নতুন পে স্কেল ২০২৬ সালের মার্চের আগেই ঘোষণা হতে পারে। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বর্তমান বেতনের তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সংবাদে খুশি দেশের সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিন্তু আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন বেসরকারি খাতে কাজ করা কয়েক কোটি মানুষ। কারণ নতুন বছরের শুরুতে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে করে দৈনন্দিন জীবনের সব পর্যায়ের খরচ। রাজধানীর বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, প্রায় এক দশক পর সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নতুন পে কমিশন গঠন করেছে সরকার। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই ঘোষণা হবে নবম পে স্কেল, যা সরকারি চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি বেতন কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ২০২৫ সালের পে কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের নজর এখন শুধু বেতন বৃদ্ধিতে নয়, বরং গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য কমিয়ে বেতন অনুপাত পুনর্গঠনের দিকেও। সর্বশেষ ২০১৫ সালে অষ্টম পে-কমিশনের সুপারিশে বেতন বৃদ্ধির পর ২০২৫ সালে নবম পে কমিশন গঠন করে সরকার। এই সময়ের অন্তত দুটি কমিশন গঠিত হলে দুইবার বেতন বাড়তো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাই এবার অন্তত ১৫০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি দরকার। পাশাপাশি বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বনিম্ন মূল বেতন হওয়া উচিত ৩২ হাজার এবং সর্বোচ্চ বেতন হওয়া উচিত এক লাখ ২৮ হাজার টাকা।

বেতন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নতুন স্কেলে মূল বেতন দ্বিগুণ হতে পারে। এই ইঙ্গিত বাস্তবায়িত হলে, বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী, প্রথম গ্রেডের সর্বোচ্চ মূল বেতন দাঁড়াবে ১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং ২০তম গ্রেডের সর্বনিম্ন বেতন হবে ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। কমিশন মনে করছে, বিদ্যমান ২০টি গ্রেড থেকে সংখ্যা কমানো হলে নিম্নতম বেতন আরও কিছুটা বাড়তে পারে। বর্তমানে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত প্রায় ১০:১, যা নতুন কাঠামোতেও ৮:১ থেকে ১০:১-এর মধ্যে রাখার বিষয়ে কমিশন পর্যালোচনা করছে।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, শহর ও গ্রামে উভয় স্থানেই জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিদিন বাড়ছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে বলে অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। সেখানেও নেই স্বস্তি। অনেকে বদল করেছেন পেশা। এমন অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়লে বেসরকারি খাতের কয়েক কোটি মানুষ আবারও নতুন করে জীবনযুদ্ধে নামবেন। এই যুদ্ধে টিকে থাকবেন কিনা জানেন না তারা।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ওই সময় আগের চেয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এই মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। সাধারণ নিয়মে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। খাদ্যের ক্ষেত্রে সেটা সামঞ্জস্য করা সবচেয়ে কঠিন। যে কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে চরম বিপদে পড়েন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

জানা গেছে, মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেই তুলনায় এখন অবস্থা অনেকটা ভালো। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়ায় এর কিছুটা সুফল মিলছে। তবে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নতুন পে স্কেল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বাড়বে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থনৈতিক স্থবিরতা কর্মসংস্থান কমিয়ে দিয়েছে। বাড়েনি মজুরি, অথচ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফ গত জুন মাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৪ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। গত ১৪ অক্টোবর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, অর্থবছর শেষে এই হার হবে ৪ দশমিক ৯।

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫’ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের ৩০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। বিবিএসের ২০২২ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তবে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। পিপিআরসির গবেষণা অনুসারে বর্তমানে প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৪ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বসবাস করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাস আগস্টে ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। বছরের তুলনায় অবশ্য কিছুটা কম। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও বাসাভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার ও আমদানি ব্যয়ের চাপ মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ। নতুন পে স্কেল এই কারণকে আরেক ধাপ এগিয়ে দেবে।

জানতে চাইলে রাজধানীতে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করা ইসমাইল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়লে আমরা তো মরে যাবো। কারণ প্রথমেই বাড়বে বাড়ি ভাড়া। বছরের শুরুতে হওয়ায় বাড়বে স্কুল-কলেজের বেতন। বাড়বে জীবনের সকল ব্যয়। আমাদের টিকে থাকার কোনও কায়দা আছে বলে মনে হয় না।’

জানা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত আটটি পে স্কেল বাস্তবায়িত হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ আট বছরের ব্যবধানে দুইবার নতুন পে স্কেল ঘোষণা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে সর্বোচ্চ বেতন দ্বিগুণ করে ৬ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন বেতন ১২২.২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ বেতন ৫৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ২৩ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন বেতন ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা করা হয়।

ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯১ সালের কমিশন সর্বোচ্চ বেতন ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন বেতন ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করে। এরপর ১৯৯৭ সালের কমিশন পাঁচ বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ বেতন ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা এবং সরকারি কর্মচারীদের সর্বনিম্ন মূল বেতন ছিল টাকা ১৫০০-২৪০০। এটি ছিল জাতীয় বেতন স্কেল, ১৯৯৭-এর সর্বনিম্ন ধাপের বেতন।

সর্বশেষ ২০১৫ সালে সর্বশেষ ঘোষিত অষ্টম পে স্কেলে সর্বোচ্চ বেতন ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৮ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন বেতন ১০১ দশমিক ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৫০ টাকা। গড় হিসেবে, গত ৪৪ বছরে সরকারি চাকরিজীবীরা প্রতি ৫ দশমিক ৫ বছর অন্তর একটি নতুন পে স্কেল পেয়েছেন। কর্মজীবীদের মতে, ১১ বছরে অন্তত দুটি স্কেল ঘোষণা হওয়া উচিত ছিল। পে কমিশন ২০২৫-এর সুপারিশ প্রণয়নে দেশের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় থাকবে বলে জানা গেছে।

এদিকে সচিবালয়ের ১১-২০তম গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, এবার অন্তত ১৫০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি দরকার। পাশাপাশি বাজারমূল্যের সঙ্গে মিল রেখে গ্রেডভিত্তিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বনিম্ন মূল বেতন হওয়া উচিত ৩২ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। কারণ ২০১৫ সালের পর অন্তত দুটি কমিশন গঠিত হলে দুইবার বেতন বাড়তো। সরকারের চলতি বছরের ডিসেম্বরে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করার সম্ভাবনা কম, তবে কমিশনের সুপারিশ ডিসেম্বরে জমা পড়ার একটি ইঙ্গিত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, নতুন পে স্কেল ২০২৬ সালের শুরু (জানুয়ারি/মার্চ/এপ্রিল) থেকে কার্যকর হতে পারে। এ বিষয়ে কাজ করছে সরকার গঠিত পে কমিশন। উৎস: বাংলা ট্রিবিউন।

 

ad

পাঠকের মতামত