বোনকে মৃত্যুর আগে যে কথা বলেছিলেন শাকিল
বাংলাডেস্ক।। তিন বোন এক ভাই। সব বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। নয় বছর আগে স্ট্রোক করে শারীরিকভাবে অচল হয়ে মা এখন বাকরুদ্ধ। বাবা মাটির হাঁড়িপাতিলের ব্যবসা করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে চলত না সংসার। মায়ের ওষুধ ও বাবাকে সংসারে সহযোগিতা করার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও টিউশনি করতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তরায় নিহত শাকিল হোসেন। কোনো দিন যদি টিউশনি শেষে শাকিল বাসায় আসতে দেরি করত, মা ততক্ষণ না খেয়েই থাকত। এখন শাকিল নেই। তাই মা জীবিত থেকেও যেন লাশ হয়ে আছেন। ছেলের শোকে কাঁদতে কাদঁতে প্রায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। শাকিলের পরনের শার্টটি (জামা) সব সময় তিনি বুকের কাছে আগলে রাখেন। এই শার্ট বুকে নিয়েই তার রাত কাটে, দিন যায়। বাকরুদ্ধ মায়ের চোখের পানি অঝোর ধারা বাসার চারপাশের পরিবেশকেও কাঁদাচ্ছে অবিরত।
শনিবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর দত্তপাড়ায় শাকিলের বাসায় গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়।
শাকিলের বড় বোন বিউটি বেগম যুগান্তরকে ভাইয়ের শেষ স্মৃতির কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ১৮ জুলাই বেলা ১১টায় আমার ভাই টিউশনি শেষে উত্তরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আমাকে ফোন করে জানায়, আপা উত্তরার পরিস্থিতি খারাপ। হয়তো যে কোনো সময় মারা যেতে পারি। চিন্তা করো না। আমরা যারা অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছি, সবার জন্য মাকে দোয়া করতে বলো। মৃত্যুর আগে মেসেজ করে জানিয়ে দেব। পরে আর মেসেজ পাইনি, জানতেও পারিনি আমার ভাই কখন মারা গেছে। মোবাইল ফোনে শেষ কথা হিসেবে এসব কথা বলে গেছেন আমার ভাই। শাকিল টঙ্গী সরকারি কলেজের বিএসএস (পাশ) ও মানারত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন ও দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকায় গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিউটি বেগম আরও বলেন, আমরা তিন বোন এক ভাই। নয় বছর আগে স্ট্রোক করে শারীরিকভাবে অচল হয়ে পড়েন মা। সেই সঙ্গে তার কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। আমাদের তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে থাকি। বাবা মাটির হাঁড়িপাতিলের ব্যবসা করে। বাবার সামান্য আয় ও শাকিলের টিউশনির টাকায় চলত সংসার। শাকিলই মায়ের খাওয়া-দাওয়াসহ সব কিছু খেয়াল রাখত। কোনো দিন যদি টিউশনি শেষে শাকিল আসতে দেরি করত, মা ততক্ষণ না খেয়েই থাকত। এখন শাকিল নেই। মা জীবিত থেকে যেন লাশ হয়ে আছে। ছেলের শোকে কাঁদতে কাদঁতে প্রায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। শাকিলের পরনের শার্টটি সব সময় তিনি বুকের কাছে আগলে রাখেন। এই শার্ট বুকে নিয়েই তার রাত কাটে, দিন কাটে। একমাত্র ছেলেকে হারানোর কষ্টের অশ্রুতে যেন চারপাশের পরিবেশও কাঁদছে। আমার মায়ের মতো আর কারও মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়, বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকেন বিউটি বেগম।
নিহত শাকিলের বাবা বেলায়েত হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি গ্রামের বাড়ি থাকাবস্থায় ১৮ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে খবর পাই। ওই দিন বিভিন্ন স্থানে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কুমিল্লার গৌরীপুর পর্যন্ত আসতে পারি। পরে লাশসহ মানারত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আমার স্বজনরা গৌরীপুর পৌঁছলে আমি তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে যাই। সেখানে কাফিলাতলী গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করি। আমার ছেলেকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। গুলি তার বুকের ভেতর দিয়ে ঢুকে পেছন দিয়ে বড় সুরঙ্গ হয়ে বেরিয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, আমার ছেলের লাশের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। তবে উত্তরার একটি মেডিকেল থেকে মৃত্যু সনদ দিয়েছে। ছেলে হত্যার বিচারের জন্য কোনো মামলা করব না। আমার চার সন্তানের মধ্যে শাকিল একমাত্র ছেলে। সে খুব মেধাবী ছিল। আমার ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করত। আজ সবই স্মৃতি হয়ে সব সময় আমার চোখে ভাসে। আমি এখন ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। আমি চাই আমার ছেলে যে উদ্দেশ্যে দেশের স্বার্থে জীবন দিয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সফল হোক। আমার ছেলেসহ যারা শহিদ হয়েছে, তাদের রক্তের বিনিময়ে যেন এ দেশে শান্তি ফিরে আসে।
টঙ্গী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গী সরকারি কলেজের বিএসএসের ছাত্র শাকিল হোসেনের আইডি নম্বর ২২০১০২১৭৬। তার বাবার নাম বেলায়েত হোসেন। বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের কাফিলাতলী গ্রামে। শাকিল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে টঙ্গীর দত্তপাড়া লেদু মোল্লা রোডে বসবাস করত। ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শাকিল হোসেন নিহত হন।
মানারত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ড. মোয়াজ্জেম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শাকিল হোসেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র ছিল। তার আইডি নং ২২১৭ বিবিএ ৫০১৫১। ১৮ জুলাই উত্তরায় ছাত্র আন্দোলনকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। পরে শাকিলকে বাংলাদেশ মেডিকেল নেওয়ার পথে সে মারা যায়।
দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শাকিল হোসেন দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উৎস: যুগান্তর।