‘পাষণ্ডরা গু.লি মেরেছে একমাত্র ছেলের বুকে, বুকটা ফুটো হয়ে গেছে’
নিউজ ডেস্ক।। ‘আমার একমাত্র ছেলের বুকে পাষণ্ডরা গুলি মেরেছে। বুকটা ফুটো হয়ে গেছে। আমার একটিমাত্র ছেলে, তাকেও আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিলো। আমি অসুস্থ, কখন মারা যাই ঠিক নাই। আমার পুরো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো।’
কিডনি রোগী বাবার চিকিৎসা ও পেটের দায়ে ঢাকার রাস্তায় সবজি বিক্রি করতে গিয়ে গুলিতে নিহত ১৯ বছর বয়সী সাগর মিয়ার বাবা কথাগুলো বলছিলেন আর অঝোরে কাঁদছিলেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর পরিবারের সবাই।
মো. হানিফ মিয়ার একমাত্র ছেলে সাগর। বাবা-মা ও দুই বোন নিয়ে মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। কিডনি রোগী বাবার চিকিৎসা ও পেটের দায়ে সাগর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সবজি বিক্রি করতেন। গত ১৯ জুলাই সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে ভ্যানে করে সবজি বিক্রির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাগর। পরদিন দুপুরে তার বাবা সাগরের লাশ নিয়ে যান গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার বড়শালঘর ইউনিয়নের বড়শালঘর গ্রামে। জানাজা শেষে বাড়ির একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সাগরের বাবা বলেন, শুক্রবার গোলাগুলির দিন আমি বারবার বলছিলাম বাবা তুই আজকে যাইস না। আমার ওষুধ ও ঘরে বাজার নাই, হাতেও টাকা ছিল না, তাই ভ্যান নিয়ে বের হইছিলো। এরপর আমি বিকালে ফোন করছিলাম, সে আমারে জানায়, আমি মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় আছি, তুমি চিন্তা কইরো না। আমি বলছি তুই বাসায় চলে আয়। আমাকে জানায়, বাবা আমি আসতে পারবো না, এখানে অনেক গোলাগুলি হচ্ছে।
‘এরপর সন্ধ্যায় ফোন দিলে তার নম্বর বন্ধ পাই। রাত ৮টার দিকে আমি সাগরকে খুঁজতে বের হই। তখনও বাহিরে টিয়ারসেল ও গোলাগুলি চলছিল। পরে রাত ১০টার পর আমি মিরপুর ১০ নম্বরে এসে সাগরের খোঁজ নিলে কেউ একজন বলেন, আপনার ছেলে কি সবজি বিক্রি করতো। আমি হ্যাঁ বললে, তিনি একটি প্রাইভেট হাসপাতালের নাম বলে বললো- ওখানে গিয়ে খোঁজ নেন, মিরপুরে যারা আহত হইছে এদের প্রায় সবাই ওই হাসপাতালে আছে। আমি দৌড়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করলে রাত ৩টার পর আমার ছেলের লাশ দেখানো হয়। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারবো না…।’
আবু হানিফ মিয়া আরও বলেন, আমার একমাত্র ছেলের বুকে পাষন্ডরা গুলি মেরেছে, বুক ফুটো হয়ে গেছে। আমার একটিমাত্র ছেলে, তাকেও আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিলো। আমি অসুস্থ, কখন মারা যাই ঠিক নাই। আমার পুরো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো। তার মা ও দুই বোন রয়েছে, তাদের দেখাশুনা কে করবে- বলেই অঝোরে কাঁদছেন আবু হানিফ মিয়া।
সাগরের ফুফু সাহিদা আক্তার বলেন, সাগর আমার একমাত্র ভাতিজা। বাড়িতে আসলে এই ঘরেই থাকতো। সাগরের বাবা অনেকদিন থেকে কেডনি রোগে ভুগছে। তার চিকিৎসার জন্য সাগর লেখাপড়া বন্ধ করে ঢাকায় সিজনালি সবজি বিক্রি করতো। সংসারে একমাত্র রোজগার করতো সাগর। সন্তান হারিয়ে আমার ভাই বার বার বেহুস হয়ে পড়ছে।
ঘরের দরজায় বসে নাতির ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছেন ৬০ বছরের বৃদ্ধা রাজিয়া খাতুন। তাকে সান্তনা দিতে এসে কাঁদছেন পাড়া-প্রতিবেশীরাও। ক্ষোভ ও ঘৃণা জানাচ্ছেন সাগরের হত্যাকারীদের প্রতি।
দাদি রাজিয়া খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, আমার নাতি বাড়িতে আইলে দুই একদিন থাইক্যা ঢাহা (ঢাকা) যাওয়ার সময় আমার লগে দুষ্টুমি করতো। বলতো দাদি তোমারে পরের বার এসে বিয়ে করমু, তুমি রেডি থাইকো, এই বলে হাসাহাসি করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতো। এলাকায় সকল ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতো। আমার নাতিরে ফিরাই আইন্না দাও, কেডা আমার নাতিরে মারলো, তার তো শত্রু নাই।
‘বাড়িতে আইলে এই ঘরে আর কেডায় থাকবো। আমারে কেডা ফোন করে বলবো, দাদি তোমার লাইগ্যা কি আনমু, তোমার ওষুধ লাগবোনি। ওরে সাগর তুই কইরে…আমার আগে তুই কেমনে মরলি? তরে কেডা গুলি করে মারলো!’
দেবিদ্বার থানার ওসি মো. নয়ন মিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত দেবিদ্বারে তিনটি মরদেহ আসার খবর পেয়েছি। ঢাকায় নিহত সাগরের বাড়ি বড়শালঘর গ্রামে। নিহতের পরিবারগুলোর খোঁজ-খবর রাখছি।
দেবিদ্বারের ইউএনও নিগার সুলতানা বলেন, ঢাকায় নিহত তিন পরিবারের সদস্যদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়ে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা তুলে দিয়েছি। সাগরের পরিবারকেও সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। উৎস: ইত্তেফাক।