355430

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস: রোগীর চাপ সামলাতে বাড়ছে ২৫০০ শয্যা

নিউজ ডেস্ক।। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যু নতুন রেকর্ড গড়ছে। আগের দিনের তুলনায় পরের দিন সংক্রমণ বাড়ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন আক্রান্ত রোগী আগের দিনের তুলনায় প্রায় পাঁচশ বেড়ে সাত হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালের ওপরও চাপ বাড়ছে।

আগের দিনের তুলনায় গতকাল হাসপাতালে রোগী ভর্তির শয্যার সংখ্যা আরও কমেছে। অনেক করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। সরকারি-বেসরকারি সর্বত্রই আইসিইউর পাশাপাশি সাধারণ শয্যার সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় করোনা রোগীদের জন্য আরও ২ হাজার ৫০০ শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

নতুন করে করোনা হাসপাতাল যুক্ত করার পাশাপাশি চিকিৎসায় আছে এমন কয়েকটি হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হচ্ছে। প্রায় ৯০ শতাংশ শয্যা বাড়ছে ঢাকায়। এর বাইরে রোগীর চাপ বেশি এমন কয়েকটি জেলায় বাড়ানো হচ্ছে ২৫০টি শয্যা।

স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া সমকালকে বলেন, নতুন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মার্কেটে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া আগে করোনা রোগীর চিকিৎসায় থাকা দুটি হাসপাতালকে আবার যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি করোনা চিকিৎসায় যুক্ত থাকা হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। কয়েকটি হাসপাতালে এরই মধ্যে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। অন্যগুলোতে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নতুন শয্যাগুলো চিকিৎসাকাজে যুক্ত হতে কতদিন লাগতে পারে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি ডা. ফরিদ। তিনি শুধু বলেন, দ্রুততম সময়ে এই শয্যাগুলো বাড়ানো হবে।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই বছরের জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু তখনও হাসপাতালের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্র বলছে, গত বছরের জুন-জুলাইয়ে সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শয্যা ফাঁকা পড়ে ছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অন্যরকম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় দফায় মানুষ করোনাভাইরাসের নতুন ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন। নতুন ধরনের এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা অধিক তীব্র। এ কারণে সংক্রমিত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে।

হাসপাতালের চিত্র :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর কভিড-১৯ ডেডিকেটেড ১০ সরকারি হাসপাতালে ২ হাজার ৫১১ সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি আছে মাত্র ১৬৯টি। ১১৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি আছে ১০টি। অর্থাৎ সাধারণ শয্যার ৯৩ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং আইসিইউ’র ৯১ দশমিক ৫২ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। ৯ বেসরকারি হাসপাতালে ৯৪৬ শয্যার মধ্যে খালি আছে ৩৬০টি। আইসিইউর ১৮৮ শয্যার মধ্যে খালি আছে ৪০টি। অর্থাৎ ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ সাধারণ শয্যায় এবং ৭৮ দশমিক ৭২ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ তথ্য গতকাল সকাল ৮টায় আপডেট করা। এরপর পুরোদিন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে প্রচণ্ড ভিড়। তাতে দিনশেষে কোনো শয্যা খালি থাকার কথা নয়।
সারাদেশের চিত্রে দেখা যায়, মোট ৯ হাজার ৭১১ সাধারণ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ৪ হাজার ২৯৯টিতে। অর্থাৎ ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। ৫৯৬টি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ৩৮৩টিতে। অর্থাৎ ৬৪ দশমিক ২৬ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি আছে।

সার্বিক চিত্র বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় রোগীর চাপ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। হাতেগোনা কিছু শয্যা ফাঁকা আছে। তবে ঢাকার বাইরে চিত্র ভালো। প্রায় ৭০ শতাংশ শয্যা এখনও খালি আছে।

নতুন ২৫০০ শয্যা :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মার্কেটটিকে পুরোপুরি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল করা হবে। এখানে এক হাজার ২৫০টি শয্যা থাকবে। এর মধ্যে এক হাজার আইসোলেশন শয্যা, ২০০ শয্যার হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) এবং ৫০ শয্যার ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) রাখা হবে। পাঁচশ শয্যার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকে পুরোপুরি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড করা হচ্ছে। আগে এই হাসপাতালে ২৭৫ শয্যায় করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা হতো। বাকি ২২৫টি শয্যায় অন্যান্য রোগী চিকিৎসা নিতেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগে ১০০ শয্যার করোনা ইউনিট ছিল। সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তা বাড়িয়ে ২০০ করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে এতদিন করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত করা হয়নি। শয্যার চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই প্রতিষ্ঠানেও ১০০ শয্যার করোনা ইউনিট চালু করা হবে। ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে এতদিন করোনা আক্রান্তদের পাশাপাশি অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা দেওয়া হতো। এখন থেকে এই হাসপাতালটি পুরোপুরি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের ভর্তির জন্য ৬০টি শয্যা ছিল। এখন আরও ৮০টি সাধারণ শয্যা এবং ১৪টি আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে।

৫০০ শয্যার মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও ৩০টি শয্যা বাড়ছে। আগে এই হাসপাতালের ৩১০টি শয্যায় রোগী ভর্তি করা হতো। এখন থেকে সাধারণ শয্যায় ৩৪০ জন এবং আইসিইউতে ১৯ জন রোগী ভর্তির সুযোগ পাবেন। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত ছিল। কিন্তু সংক্রমণ কমে আসার পর গত বছরের শেষ দিকে সেটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালটি আবার করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ফিরছে। এখানে ১০০ শয্যার ইউনিট চালু হবে। একইভাবে মিরপুরের লালকুঠি মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালে ১০০ শয্যার করোনা ইউনিট আবার চালু হবে। পাশাপাশি কেরানীগঞ্জের জিনজিরার ২০ শয্যা হাসপাতালকেও করোনা চিকিৎসায় ফেরানো হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের খানপুর হাসপাতালে ৫০টি শয্যা বাড়ানো হবে। গত বছর করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে যুক্ত করা হয়েছিল। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ও হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়। দুই মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেই চুক্তি বাতিল করে সরকার। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আবারও হাসপাতালটিকে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ফেরানোর চিন্তাভাবনা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ। এ হাসপাতালে দেড়শর মতো শয্যা রয়েছে।

এর বাইরে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল এবং জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হচ্ছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও কভিড-১৯ ডেডিকেটেড শয্যা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ল্যাবএইড, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল এরই মধ্যে শয্যা বৃদ্ধি করেছে। অন্য আরও কয়েকটি হাসপাতাল দ্রুততম সময়ে কভিড-১৯ ডেডিকেটেড শয্যা বৃদ্ধি করবে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকরের তাগিদ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিলম্বে হলেও শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে দ্রুততম সময়ে শয্যাগুলো রোগী ভর্তির উপযোগী করে তুলতে হবে। অন্যথায় বিপদ বাড়বে। একই সঙ্গে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ও হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার প্রতি জোর দিতে হবে। কারণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া রোগী যাতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সাপোর্ট পান, তা নিশ্চিত করা এই চিকিৎসার প্রধান কাজ। সুতরাং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, করোনার নতুন ধরনে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে- এখন এটি নিশ্চিত। আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণ এবং পাতলা পায়খানা হচ্ছে। এর তীব্রতাও অনেক বেশি। সুতরাং এ ধরনের সঙ্গে মিল রেখে চিকিৎসা পদ্ধতি ও শয্যাসংখ্যা প্রস্তুত করতে হবে। অন্যথায় শয্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। হাসপাতালে ভর্তির পর যাতে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দ্রুততম সময়ে কার্যকর করতে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনা চিকিৎসায় সম্পৃক্ত আছে, এমন হাসপাতালগুলোয় এরই মধ্যে শয্যা বাড়ানো হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের মার্কেটে হাসপাতাল তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাজধানীর বাইরে পরিস্থিতি তেমন গুরুতর নয়। অধিকাংশ শয্যাই ফাঁকা। রাজধানীর বাইরে যে কয়েকটি স্থানে রোগীর চাপ বেড়েছে, সেগুলোয় শয্যা বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতির আলোকে শয্যা বৃদ্ধিসহ সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। উৎস: দৈনিক সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত