355160

মুখে বন্দুক ঠেকিয়ে পুলিশের সামনে ব্যবসায়ীকে হত্যা

নিউজ ডেস্ক।। ‘ধৈর্যের সীমারেখা অতিক্রম করলে টর্নেডো হবার আশঙ্কা খুব বেশি, সাধু সাবধান’—আগের রাতে ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়ে পরদিন সকালে পুলিশের সামনেই রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদকে (৩৯) গুলি করে হত্যা করেন আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান (৪৮)।

এমনকি হত্যার দৃশ্য হান্নানের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করেন তারই মেয়ে। গতকাল রাজধানীর দক্ষিণখানে এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

ঘটনার সময় গোরস্থানের পাশে রঙের কাজ করছিলেন দক্ষিণখানের নদ্দাপাড়া এলাকার মোক্তার বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. রুবেল। তিনি জানান, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছিল।

জাপানি হান্নান ও নিহত আব্দুর রশিদের মধ্যে বালু চুরি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে গেটের বাইরে এসেই হান্নান তার হাতে থাকা শটগান রশিদের মুখে ঠেকিয়ে গুলি করেন। এতে রশিদ ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে বাড়ির ভেতরে চলে যান হান্নান। এ সময় হান্নানের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করছিলেন তার মেয়ে। ঘটনার সময় পাশেই পুলিশ ছিল। তিনি আরো জানান, নিজের লোকজনকে মারধরের খবর পেয়ে রশিদ ও তার লোকজন এসেছিলেন। এসেই তিনি খুন হলেন।

রাজধানীর দক্ষিণখান থানার আইনুসবাগের পানির পাম্প সড়কে হান্নানের বাড়ি ‘জাপানি কটেজ’ ভবনের সামনে গতকাল বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ঐ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে। দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকার ডিলার বাড়ির মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে নিহত রশিদ। দক্ষিণখানের নদ্দাপাড়া এলাকায় তার রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে। গুলির পর পরই কয়েক জন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিত্সক রশিদকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের কপালের ডানপাশে গুলির চিহ্ন রয়েছে।

এ ঘটনায় জাপানি হান্নানসহ সাত জনকে আটক করেছে পুলিশ। অন্যরা হলেন, হান্নানের ছেলে ইকরামুল ইসলাম জয় (২৬), ভাই শফিকুল ইসলাম ইমরান (৪১), চাচা তো ভাই আল আমিন প্রবীণ (৩৫), জুয়েল ইসলাম রিপন (৪১) ও খোরশেদ আলম (৫০)। পুলিশ হান্নানের বাড়ি থেকে ঘটনায় ব্যবহূত শটগানসহ দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। আটক হান্নানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার হাইমচর এলাকায়। তিনি জাপানি কটেজে স্ত্রী এবং দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করত।

জাপানি হান্নান নিজেকে বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি, জাপান-বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলে দাবি করেন। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, হান্নান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত নন, তিনি স্বঘোষিত নেতা। সাবেক মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ভোটে অংশ নেন তিনি।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান ও নিহত আব্দুর রশিদের পরিবারের সঙ্গে ময়লা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জেরে সামান্য বালু চুরিকে কেন্দ্র করে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। তারা বলেন, গত সোমবার ও মঙ্গলবার রাতে জাপানি হান্নানের বাড়ি সংলগ্ন সড়কে বাউন্ডারির কাজ করাতে কয়েক ট্রাক বালু রাখেন রশিদ। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রশিদের ভাইরা এসে বালু কম দেখেন। চুরি হওয়া ঐ বালু হান্নান নিয়েছেন বলে দাবি করতে থাকেন তারা। এ বিষয়ে হান্নানকে জিজ্ঞাসা করতে গেলে হান্নানের ১৫/২০ জন লোক রশিদের তিন-চার জন ভাইকে লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে আব্দুর রশিদ ও তার মামা তো ভাই সোহেল রেজাসহ আরো লোকজন আসেন। দক্ষিণখান থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আজিজও ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে জাপানি হান্নান সঙ্গে থাকা শটগান দিয়ে গুলি করেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আব্দুর রশিদ ঘটনাস্থলেই মারা যান। এছাড়াও জাপানি হান্নান তর্ক-বিতর্ককালে বহুবার আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ছুড়েছেন।

হত্যার পর আমিনুল ইসলাম হান্নানের ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেছে, মঙ্গলবার রাতে ‘ধৈর্যের সীমারেখা অতিক্রম করলে টর্নেডো হবার আশঙ্কা খুব বেশি, সাধু সাবধান’ লিখে স্ট্যাটাস দেন তিনি। হত্যার সময় তার ফেসবুক আইডি থেকে ঐ দৃশ্য লাইভ করেন হান্নানের মেয়ে। ঐ লাইভে এ হত্যায় ব্যবহৃত শটগানটিও দেখানো হয়েছে। লাইভে হান্নানের মেয়ে বলতে থাকেন, ‘আমাদের বাসার সামনে পাঁচ-ছয় শ জন লোক জড়ো হয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছেন। তারা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। এখানে মাত্র কয়েক জন পুলিশ রয়েছেন। এখানে আরও র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দরকার। আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকে দ্রুত চলে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

এদিকে হত্যার ঘটনায় উত্তেজিত এলাকাবাসী ও আব্দুর রশিদের স্বজনেরা জাপানি হান্নানের বাসার সামনে থাকা একটি প্রাইভেটকারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেন। জাপানি হান্নানের বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুরও চালান তারা। উত্তরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দুইটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিব হাসান ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা শান্ত হোন। কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছে। তারাই আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জেরে আমিনুল ইসলাম হান্নান ওরফে জাপানি হান্নান তার শর্টগানের গুলিতে ঐ ব্যবসায়ীকে হত্যা করেন। ঘটনার পর পরই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে নিরস্ত্র ও হান্নানসহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।’

হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিতি থাকা দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, সকালে দুইপক্ষের মারামারি হয়েছে। পরে একপক্ষের লোক গুলি করে একজনকে মেরে ফেলেছেন। তার সামনেই খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাবলিক অনেকেই অনেক কিছু বলবে। আমাদের সামনে এমন ঘটনা ঘটলে আমরা ফিরাইতাম না। আমরা তো প্রটেকশন দিতেই যাই, পাবলিককে বাঁচাতেই যাই। আমরা কি পাবলিককে মারতে যাই? আমরা তো পাবলিকেরই চাকরি করি।’ উৎস: ইত্তেফাক।

ad

পাঠকের মতামত