354862

এক নক্ষত্রের বিদায়

নিউজ ডেস্ক।। চলে গেলেন বরেণ্য রাজনীতিক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আজ মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের একজন রাজনীতিক নক্ষত্রের বিদায় হলো। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

তার মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘খুব বেদনাহত সংবাদ- মওদুদ আহমদ আর নেই।’

মওদুদ আহমদের একান্ত সচিব মমিনুর রহমান সুজন দৈনিক আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, মৃতদেহ আগামী বৃহস্পতিবার দেশে আনার চেষ্টা চলছে। তার দাফন হবে পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে।

মওদুদ আহমদ একজন ভাষা সৈনকি ও মুক্তিযোদ্ধা। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কারাবরণও করেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ছিলেন।

মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি গভীর শোক জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় পার্টি (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃতবৃন্দ তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।

বিএনপির বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, কেন্দ্রীয় নেতা বরকত উল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জয়নুল আবদিন ফারুক, রুহুল কবির রিজভী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, হাবিব উন নবী সোহেল, তাবিথ আউয়াল, বজলুল করীম চৌধুরী আবেদসহ অনেক রাজনীতিকও মওদুদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।

মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরও শোক জানিয়েছেন—আবুল খায়ের ভূইয়া, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, মাহবুবের রহমান শামিম, এবি পার্টির আহ্বায়ক সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী ও সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।

মরহুমের বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘মওদুদ আহমদের এই চলে যাওয়া জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি সারা দেশের একজন মরুব্বী ছিলেন। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আইনজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে, দেশের জনগণ একজন জনপ্রতিনিধিকে হারালো।’

গত ১ ফেব্রুয়ারিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য মওদুদ সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মওদুদ আহমদের একান্ত সহকারী মোমিনুর রহমান সুজন বলেন, ‘স্যার হাসপাতালে আইসিউতে ছিলেন। গত কয়েকদিন ধরেই তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল।’

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মওদুদ আহমদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। তিনি উপমহাদেশের অন্যতম আইনজ্ঞতে হারালো। বিএনপি ও বাংলাদেশ হারালো একজন অভিভাবককে। তার এই মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগতভাবে শোকগ্রস্ত। কারণ তার সাথে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। তিনি আমাদের বিএনপির একজন অভিভাবক ছিলেন। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’

গত ৩০ ডিসেম্বর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান হ্রাস, বুকে ব্যথা অনুভব করলে মওদুদ আহমদকে ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর গত ৭ জানুয়ারি তার হৃদযন্ত্রে স্থায়ী পেস মেকার স্থাপন করা হয়। ফুসফুসে পানি জমে গেলে এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে ১ ফেব্রুয়ারি তাকে সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর এভার কেয়ারে ভর্তির আগে ৮ থেকে ১০ দিন ধরে তিনি অসুস্থতা বোধ করছিলেন। তবে বাসায় চিকিৎসা চলছিল বলে পরিবারের সদস্যরা জানান। সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী হাসনা মওদুদ আহমেদ।

মওদুদ আহমদ তার রাজনৈতিক জীবনে কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত হয়েছে। আলোচনায় ছিলেন পুরো রাজনৈতিক জীবনে। রাজনীতিক নানা বাঁক বদলের স্বাক্ষী ছিলেন এই নেতা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন আইনজীবী ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ছিলেন।

১৯৭৭-৭৯ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে মওদুদ আহমদও দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে জিয়াউর রহমান নিহত হন এবং এক বছরের ভেতর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করার পর বিশেষ সামরিক আদালতে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন এই রাজনীতিক। ১৯৮৫ সালে সেই দণ্ড মাথায় নিয়েই এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি হন মওদুদ আহমেদ। এরশাদের পতনের পর ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি জাতীয় পার্টিতে ছিলেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন।

মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল ছিলেন। মওদুদ আহমদের স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ পল্লী কবি হিসেবে খ্যাত কবি জসীম উদ্দীনের মেয়ে। পাঁচবার মওদুদ আহমেদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া বগুড়া-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

 

ad

পাঠকের মতামত