352189

‘টিকা নিলেও মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে’

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৯টি কম্পানি এই টিকা নিয়ে কাজ করছে। তবে কোন ভ্যাকসিন শেষ পর্যন্ত কতটুকু কার্যকর হবে তা নির্ভর করছে ওই ভ্যাকসিনের ফেইজ-১/২/৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলের ওপর।

টিকার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয় ওই জীবাণুটির বিরুদ্ধে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং টি-সেলকে (এক ধরনের শ্বেতকণিকা) যথাযথ প্রস্তুতকরণের মাধ্যমে। এখন যে ভ্যাকসিনটি এই দুটি প্রক্রিয়াকে একই সঙ্গে উজ্জীবিত করতে পারবে, সেটিই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ভ্যাকসিন; যা দিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা। তবে চলমান করোনা ভ্যাকসিনগুলো কত দিন সুরক্ষা দেবে সেটি এখনো গবেষণাধীন। সঠিক তথ্য পেতে আরো হয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। আতঙ্কের কিছু আছে কি?

সব ভ্যাকসিনেরই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। মূলত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পরীক্ষামূলক ফল নিয়ে সংশয়, অনুমোদন নিয়ে তড়িঘড়ি ইত্যাদি কারণে করোনার টিকা নিয়ে আতঙ্ক, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংশয় এখনো বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের জনগণও এর বাইরে নয়। তবে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে চাই যে এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নয়। বরং করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে টিকা নেওয়া উচিত। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে মাথা ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে বলে জানা গেছে। তবে অল্প কিছু ওষুধ সেবন করলে এই উপসর্গগুলো কিন্তু ভালো হয়ে যায়।

গর্ভবতী মা, ১৮ বছরের কম বয়সী অথবা শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না কেন?

এখন পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে তিনটি কম্পানির ভ্যাকসিন। এসব ভ্যাকসিনের উৎপাদনকারী কম্পানিগুলো তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কোনো ধাপেই গর্ভবতী মা, ১৮ বছরের কম বয়সী বা শিশুদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তাই গবেষকরা নিশ্চিত নন যে এই ভ্যাকসিন তাদের বিরুদ্ধে এখন কার্যকর ও নিরাপদ কি না। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে থাকা কম্পানিগুলো বর্তমানে পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করছেন। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে যে টিকাগুলো আসবে সেগুলো শিশুদের ওপর প্রয়োগ নিরাপদ হবে।

ভ্যাকসিন নিলেও কি মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে?

ভ্যাকসিন নিলেও মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা এমনকি সংক্রমণ হলেও অসুখের তীব্রতা কমিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকেও রক্ষা করবে এই ভ্যাকসিন। আবার ভ্যাকসিন নিলেও অনেকে এ-সিম্পমেটিক ক্যারিয়ার হতে পারে। তখন তার মাধ্যমে অন্যরাও আক্রান্ত হয়ে জটিল হতে পারে। এ জন্য সবাইকে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও মাস্ক পরা, হাত ধোয়াসহ শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।

করোনার নতুন স্ট্রেইন ঠেকাতে কী ধরনের সতর্কতা নেওয়া দরকার?

ভাইরাস মাত্রই বারবার রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত হয়, যাকে ‘মিউটেশন’ বলে। তবে এই রূপান্তর সব সময় ভয়ংকর হয় না। কখনো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে ব্রিটেনসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশে এই স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। নতুন এই স্ট্রেইন যাতে বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে এ জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেশন অনুযায়ী এই মুহূর্তে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করতে হবে, করোনা টেস্ট করতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তবেই আশা করা যায় নতুন স্ট্রেইন ঠেকানো সম্ভব।

হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও আইসিইউয়ের সুবিধা কি দেশে অপ্রতুল?

করোনা সংক্রমণ শুরুর দিকে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংকট থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে এক হাজারের মতো রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে জনবলও তৈরি করা হয়েছে। তবু তা পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এক হাজার দুই শর মতো আইসিইউ বেড রয়েছে। সারা দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে এটাও অনেক কম। তা ছাড়া এসব আইসিইউ সুবিধার ৭০-৮০ শতাংশ রাজধানীকেন্দ্রিক। তাই আইসিইউ বেড বাড়ানো দরকার। সম্প্রতি সরকার অবশ্য এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। আমার মতে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উচিত ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরেও বড় বড় হাসপাতাল তৈরিতে এগিয়ে আসা।

অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

করোনা মহামারি মোকাবেলায় এই দুটি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত এবং সহজে (১৫-২০ মিনিটের মধ্যে) করোনা সংক্রমণ নির্ণয় করা যায় অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে। অনেক দেশে এই র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টটির অনুমোদন মহামারির শুরুর দিকে দিলেও বাংলাদেশে বেশ দেরিতেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে (সিডিসি গাইডলাইন অনুযায়ী)। বর্তমানে ৫১টি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এর কার্যক্রম চলছে।

অন্যদিকে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা কোনো ডায়াগনস্টিক টেস্ট নয়। একে সেরোলজিক টেস্ট বলা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়, কেউ সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না। কনভালসান প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার আগে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা জরুরি। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যাওয়ার ২১ দিন পর এই পরীক্ষা করতে হয়। কেননা দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি পাওয়া গেলেই তিনি অন্য ব্যক্তিকে প্লাজমা দিতে পারেন।

টিকা প্রদানের জন্য ডাব্লিউএইচওর কি আলাদা কোনো অনুমোদন লাগে?

ভ্যাকসিনের অনুমোদন কয়েকটি ধাপে হয়ে থাকে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম তিনটি ধাপ শেষ হওয়ার পর প্রতিটি ধাপের ফলাফল PEER রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়। এরপর ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য দেশের সর্বোচ্চ সংস্থার কাছে অনুমোদনের Investigation New Drug (IND) জন্য আবেদন করা হয়। এফডিএসহ সর্বোচ্চ সংস্থা অনুমোদন দিলে ভ্যাকসিন উৎপাদনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর উৎপাদনকারী দেশের অনুমোদন, প্রদানকারী দেশের অনুমোদনসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেতে হয়। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উৎপাদিত কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের MHRA থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। ভারতের হেলথ রেগুলেটরি অনুমোদন দেয় ৩ জানুয়ারি এবং বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন দেয় ৭ জানুয়ারি। এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ।

ভ্যাকসিনেশনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় কোনো চ্যালেঞ্জ আছে বলে কি মনে হচ্ছে?

জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য ২৬ জানুয়ারি থেকে নাম নিবন্ধনের কাজ শুরু হবে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে, যাতে মোবাইল নম্বর ও এনআইডি নম্বর দিয়ে ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত হতে হবে। তবে সবার স্মার্টফোন নেই বলে টিকার এই নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি।

আমার জানা মতে, দেশের ১১ কোটি মানুষের এনআইডি রয়েছে। বিটিআরসির তথ্য মতে, অ্যাকটিভ সিম কার্ড আছে ১৬ কোটি ৮৪ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ (সাত কোটি) মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। স্মার্টফোন না থাকার কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের সব মানুষ নিবন্ধন করতে পারবে না। তাই নিবন্ধনের জন্য আরো দু-একটি বিকল্প ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করি।

 

ad

পাঠকের মতামত