
চীনে মুসলমানদের জোরপূর্বক খাটানোর পক্ষে অ্যাপল-নাইকি-কোকাকোলা
মার্কিন কোম্পানিকে জোরপূর্বক শ্রমের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন থেকে বিরত রাখতে মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব পাস হয়। যা এখন সিনেটে পাসের মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু মার্কিন কোম্পানি নাইকি, কোকা-কোলা এবং অ্যাপল প্রস্তাবিত আইনের নিয়মনীতি শিথিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। রোববার নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
অ্যাপল, নাইকি এবং কোকা-কোলার বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক নির্যাতন এবং শ্রমিক শোষণ করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ তিন কোম্পানি সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নির্যাতন করে চীনে। সংকট সমাধানে প্রতিষ্ঠানগুলো পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণ দুরূহ হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
উইঘুর ফোর্সড লেবার প্রিভেনশন আইনের আওতায় জিনজিয়ানের চীনা কোম্পানিকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করে পণ্য তৈরি করছে না। যদি না পারে তাহলে মার্কিন প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারবে না। মার্কিন কোম্পানির উৎপাদন কারখানাও নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে।
অঞ্চলটিতে বন্দিশালায় আটকে রেখে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করানো হচ্ছে বলে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়েও অভিযুক্ত বেইজিং।
সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে উইঘুর ফোর্সড লেবার প্রিভেনশন প্রস্তাব পাস হয়। পক্ষে ভোট পড়ে ৪০৬টি। বিপক্ষে যায় ৩টি। সংশ্লিষ্টরা টাইমসকে জানিয়েছেন, প্রস্তাবটি পাসের জন্য মার্কিন সিনেটে পর্যাপ্ত সমর্থন রয়েছে।
এইচএসবিসি, আমেরিকান অ্যাপারেল, দি ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশন এবং মার্কিন চেম্বার অব কমার্সসহ আরও বেশ কয়েকটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত আইন শিথিলের জন্য তদবির করছে। লবিং ডিসক্লোজার ফার্মস এ তথ্য জানায়। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
টাইমসকে দেয়া এক বিবৃতিতে অ্যাপল দাবি করেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাবিত আইন শিথিল করার চেষ্টা করেছে।
নাইকির গ্লোবাল কমিউনিকেশনস ডাইরেকটর গ্রেগ রোসিটার টাইমসকে বলেন, প্রস্তাবিত আইনের বিরোধিতা করে কোনো তদবির করেনি তারা। বরং কংগ্রেসের কর্মীদের সঙ্গে প্রস্তাবের বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে।
কোকা-কোলা টাইমসকে দেয়া বিবৃতিতে জানায়, তাদের সাপ্লাই চেইনে যে কোনো ধরনের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
টাইমসের প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেছে মার্কিন চেম্বার অব কমার্স। তার পরিবর্তে নভেম্বরে তারাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সই করা একটি চিঠি তুলে ধরা হয়। যেখানে বলা হয়েছে, জোরপূর্বক শ্রম বন্ধে সহযোগিতা করছে তারা।
কাজাখস, কিরগিজ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ১০ লাখের বেশি মুসলমানকে জিনজিয়ানের বন্দিশালায় আটকে রেখেছে চীন। ওই অঞ্চলে ব্যাপক নজরদারির পাশাপাশি গণআটক নিত্যদিনের ঘটনা। মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য স্বাধীন গবেষকরা এ বিষয়ে ব্যাপক তথ্য প্রমাণ হাজির করেছে। যেখানে বলা হয়, সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং জোরপূর্বক শ্রমে বা নামে মাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে।
মার্চে অস্ট্রেলিয়ার স্ট্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট (এএসপিআই) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বলা হয়, ৮০ হাজার উইঘুরকে জোরপূর্বক চীনের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে। যেসব কোম্পানিতে উইঘুরদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করানো হচ্ছে তার মধ্যে অ্যাপল, নাইকি, বিএমডব্লিউ এবং অ্যামাজনের সাপ্লাই চেইন রয়েছে বলে তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
মার্চে মার্কিন কংগ্রেসনাল এক্সিকিউটিভ কমিশন এক প্রতিবেদনে নাইকি এবং কোকা-কোলা ছাড়াও অ্যাডিডাস, ক্যাম্পবেল সোপ, কোস্টকো, এইচ অ্যান্ড এম, ক্রাফট হেইনজ, পাতাগোনিয়া এবং টমি হিলফিগারের মতো বড় বড় কোম্পানি জিনজিয়ানে উইঘুরসহ সংখ্যালঘু মুসলমানদের থেকে জোরপূর্বক আদায় করা শ্রমের উপর নির্ভর করে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
মার্চে এক বিবৃতিতে নাইকি জানায়, জিনজিয়ান থেকে তারা সরাসরি কোনো পণ্য উৎপাদন করে না। যাদের কাছ থেকে ক্রয় করে তারাও ওই অঞ্চল থেকে কাপড় বা কাটা সুতা কেনে না। টাইমসকেও নাইক জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে কিংদাওয়ে অবস্থিত তাদের কারখানায় উইঘুরদের শ্রমিক হিসেব নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না।
চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাতে এএসপিআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৮০০ উইঘুর নাইকির কারখানায় জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য হয়েছে।
কোকা-কোলা টাইমসকে জানায়, জিনজিয়ানে তাদের কোফকো তুনহে প্ল্যান্টে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে-এমন অভিযোগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরে ২০১৯ সালে স্বাধীন পর্যবেক্ষণ দল দিয়ে কারখানা নিরীক্ষা করা হয় বলেও জানানো হয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যেসব কোম্পানি এতে জড়িত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চলতি বছরের শুরুতে উইঘুর বাধ্যশ্রম বন্ধে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাস করে মার্কিন কংগ্রেস। নতুন আইনে নাইকি, কোকা-কোকা, অ্যাপেলের মতো কোম্পানিকে বেশি নজরদারির আওতায় আনা হবে। তারা কোথায় পণ্য বানাচ্ছে, কাদেরকে দিয়ে বানাচ্ছে, এসব তথ্য আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
কংগ্রেসে প্রস্তাব পাসের পরেই মার্কিন অধিকাংশ কোম্পানি প্রস্তাবিত আইনের নিয়তনীতি ,শর্তকে দুর্বল করার জন্য নানাধরনের তদবির চালিয়ে যাচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুতে অ্যাপল প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে তদবির চালিয়েছে বলে জানায় ওয়াশিংটন পোস্ট। টাইমস জানায়, আইন পাসে বিলম্বের জন্য চাপ দিয়েছে অ্যাপল। বিস্তারিত তথ্য জনসম্মুখে আসেনি। চীন সরকার মুসলমানদের নির্যাতনে জড়িত কি না তা আরও খতিয়ে দেখতে মার্কিন সরকারের প্রতি চাপ তৈরি করে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল।
সেপ্টেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, পশ্চিমা কোম্পানি তিনটি তাদের কারখানা পরিদর্শনের জন্য ৫ টি বড় পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে। কিন্তু চীনা সরকারের বিধিনিষেধের কারণে দেশটির কর্মপরিবেশ স্বাধীন এবং কার্যকরভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার