348574

সন্তানের আশায় শুয়ে আছেন নারীরা, তাদের ওপর দিয়ে হাঁটছেন পুরোহিত!

নারীরা রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। তাদের পিঠ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন পুরোহিত-ওঝার দল। ভারতের ছত্তিশগড়ের এক মেলায় ফি বছর এমনই অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। এভাবেই নাকি সন্তানের ইচ্ছেপূরণ হয় এলাকার আদিবাসী নারীদের।

এই তথাকথিত আধুনিক সময়েও ধর্মীয় কুসংস্কারের শেকড় যে মানুষজনের মনের কতটা গভীরে গেঁথে রয়েছে, তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ছত্তিশগড়ের এই প্রাচীন প্রথা।

গত ২১ নভেম্বর করোনার তোয়াক্কা না করে ছত্তিশগড়ের ধমতরী জেলার মড়ই মেলা শুরু হয়। করোনার সংক্রমণ এড়াতে শারীরিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা বা মুখোশ পরার প্রশাসনিক সতর্কবার্তা এড়িয়েই চলছে এই মেলা। সম্প্রতি সেই মেলারই একটি ছবি দেখে হতবাক অনেকেই।

মেলায় আশপাশের ৫২টি গ্রাম থেকে জড়ো হয়েছেন নারীরা। অঙ্গারমতী দেবীর মন্দিরের সামনের রাস্তায় প্রায় ২০০ নারী উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন। আর মন্ত্র পড়তে পড়তে তাদের পিঠের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছেন পতাকাধারী পুরোহিত-ওঝারা। দেবী অঙ্গারমতীর কাছে এভাবে প্রার্থনা করলেই নাকি সন্তানসম্ভবা হবেন তারা। স্থানীয়দের একাংশের মনে বদ্ধমূল সে ধারণা।

দেওয়ালির পর প্রথম শুক্রবার বসে মড়ই মেলা। স্থানীয়দের মতে, এটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো প্রথা। একইসঙ্গে স্থানীয় দেবী অঙ্গারমতীর আরাধনাও চলে। তাতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষের জমায়েত হয়। তবে মেলায় নারীদের ওপর পুরোহিত-ওঝার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যে স্তম্ভিত বহু নেটাগরিক। ছত্তিশগড়ের আদিবাসী এলাকার ওই প্রথা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

প্রাচীন এই প্রথা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সমালোচনা শুরু হলেও ভাবলেশহীন মেলার উদ্যাক্তা তথা ‘আদিশক্তি মা অঙ্গারমতী ট্রাস্ট’-এর সচিব আর এন ধ্রুব। তার কথায়, ‘মানুষ শ্রদ্ধাভরে এই মেলায় জমা হয়েছেন। এর ভুল ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না।’

সুপ্রাচীন এই প্রথা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার কথাই বলেছেন ধ্রুব। তিনি বলেন, ‘অনেকের বিশ্বাস, গত ৫০০ বছর ধরে এই মেলা বসছে। আমরা সেই ঐতিহ্যকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মানুষজন নিজের বিশ্বাসেই এখানে জমায়েত হচ্ছেন।’

নারীদের ওপর দিয়ে পুরোহিত-ওঝাদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য নিয়েও মুখ খুলেছেন ট্রাস্টের সচিব। তার দাবি, ‘অতীতে বহু নারী এই মেলায় অংশ নেওয়ার পর সন্তানধারণ করেছেন, যা সত্যিই অলৌকিক ব্যাপার।’

মেলায় যোগ দেওয়ার পর অনেকে সন্তানলাভ করেছেন, এমন ঘটনার কথা মানতে নারাজ দীনেশ মিশ্র। বিজ্ঞানের প্রসারে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছত্তিশগড়ের এই চিকিৎসকের লড়াই ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। দীনেশের মন্তব্য, ‘বিজ্ঞানের এতটাই অগ্রগতি হয়েছে, যে সন্তানধারণের জন্য অজস্র উপায় রয়েছে। ফলে এ ধরনের প্রথাকে উৎসাহ দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।’

দীনেশের সঙ্গে একমত ছত্তিশগড়ের রাজ্য নারী কমিশনের চেয়ারপারসন কিরণময়ী নায়েক। তার দাবি, এমন কোনও ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি যে মেলায় অংশ নেওয়ার পর কেউ সন্তানধারণ করেছেন। এই প্রথা বিলোপের জন্য সরব হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কিরণময়ীর মতে, এ ধরনের প্রথা নারীদের স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকারক।

ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত না করেই স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা প্রসারের পক্ষে সওয়াল করেছেন কিরণময়ী নায়েক। ওই এলাকা পরিদর্শন করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘এই প্রথা বিলোপের জন্য স্থানীয় নারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে কথাবার্তা চালানো হবে। তা ছাড়া, কীভাবে সহজে সন্তানধারণ করা যায়, সে সম্পর্কেও তাদের বোঝানো হবে।’

এই প্রথা নিয়ে সরব হওয়ার পাশাপাশি নেটাগরিকদের একাংশের প্রশ্ন, করোনার সংক্রমণ রুখতে যখন গোটা দেশেই প্রশাসনিক কড়াকড়ি চলছে, সে সময় কীভাবে এই জমায়েতের অনুমতি দেয় স্থানীয় প্রশাসন? তবে সে প্রশ্নেও যেন নজর নেই স্থানীয় প্রশাসনের।

জেলা প্রশাসনের নির্বিকার থাকলেও নিশ্চুপ থাকেননি দীনেশ। তার দাবি, ‘নিজেদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সবাই প্রার্থনা করতে পারেন। তবে এই ধরনের প্রথা অমানবিক এবং অবৈজ্ঞানিক। এতে যে নারীদের মাটির উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন, তাদের গুরুতর চোটআঘাত লাগারও আশঙ্কা রয়েছে। কুসংস্কারের বশে মানুষজন যেন মধ্যযুগেই পড়ে রয়েছেন।’

স্থানীয় প্রশাসনের সমালোচনাতেও মুখ খুলেছেন দীনেশ। তিনি বলেন, ‘অতিমারির সময়েও এই জমায়েত রুখতে কিছুই ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।’

সেই সঙ্গে তার প্রশ্ন, ‘এ ধরনের প্রথা কি কেবলমাত্র গরিব আদিবাসীদের জন্য? এই প্রথা বন্ধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাব।’

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।

ad

পাঠকের মতামত