344836

যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১ ভোটে নির্ধারিত হয়েছিল যে নির্বাচনের ফল

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং বিতর্কিত নির্বাচন ছিল ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং আল গোরের মধ্যে এ নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল তীব্র বিবাদ। অনেক আইনি লড়াইয়ের পর নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছিল সুপ্রিমকোর্ট থেকে। খবর বিবিসির।

এ রকম নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র আর কখনও দেখেনি। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান এতটা কম আর কখনও ছিল না। নির্বাচনের ফল ঘিরে এক মাস ধরে চলেছিল অনেক নাটকীয় ঘটনা। আল গোরের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে তখন কাজ করেছেন ক্যালি শেল।

সেবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন আল গোর। এর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। তিনি এর আগে টেক্সাসের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আশা করছিলেন, তার বাবা জর্জ বুশের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন।

কিন্তু নভেম্বরের ৭ তারিখে ভোটের দিন পর্যন্ত এ নির্বাচনে কে জিতবে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কারণ জনমত জরিপে দুজনের ব্যবধান ছিল খুবই কম। ক্যালি শেলের মতে, আল গোর শিবির ছিল বেশ আশাবাদী, খুবই উদ্দীপ্ত। ভোটের যে হিসাব আসছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল একেবারে হাড্ডহাড্ডি লড়াই হচ্ছে, দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুবই কম।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজ বলে যে পদ্ধতি চালু আছে, তাতে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিটি রাজ্যের জন্য ঠিক করা হয় ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা। কিছু রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা মাত্র তিনটি বা চারটি। আবার বড় রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।

২০০০ সালে ফ্লোরিডার ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ছিল ২৫টি। কাজেই সেবার নির্বাচনে অন্য সব রাজ্যের ফলে যখন দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুবই কম, তখন ফ্লোরিডাতেই এ নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হতে যাচ্ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন টাইম রাত ৮টার সময় বড় কয়েকটি টিভি নেটওয়ার্ক ঘোষণা করে বসলো– ফ্লোরিডায় জিতেছেন আল গোর। তার মানে তিনিই প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। আল গোর এবং তার পরিবার যখন এই খবর শুনছিলেন, তখন সেখানে ছিলেন ফটোগ্রাফার ক্যালি শেল।

কিন্তু তার পরই আল গোরের কাছে ফোন কল আসতে লাগল তার ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের কাছ থেকে। ক্যাম্পেইন ম্যানেজার বলছিলেন– এই ফল বারবার পাল্টে যাচ্ছে। তার পর সাংবাদিকরাও বলতে শুরু করলেন, ফ্লোরিডায় অনেক বড় ঝামেলা আছে…।

ফ্লোরিডার বিভিন্ন দিক থেকে তখন যে ধরনের খবর আসছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হতে যাচ্ছেন, সেটি জানতে বেশ দেরি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যালট পেপার একেক রাজ্যে একেক রকম। এমনকি তাদের ভোট দেয়ার নিয়ম-কানুনও একেক জায়গায় একেক রকম।

একই রাজ্যেই হয়তো কোনো জেলায় ভোট নেয়া হচ্ছে ইলেকট্রনিক মেশিনে, কোথাও ব্যালট পেপারে ক্রস চিহ্ন দিয়ে। কোথাও হয়তো একটা পেপারে ছিদ্র করে তারা চিহ্ণিত করছে কাকে ভোট দিচ্ছে। এটাকে বলে চ্যাড। মনে হচ্ছিল টিভি নেটওয়ার্কগুলো যেন তাড়াহুড়ো করে আল গোরকে নির্বাচিত ঘোষণা করে দিয়েছে।

নির্বাচনের ফল নিয়ে অব্যাহতভাবে চলছিল নানা জল্পনা। সেই সঙ্গে বিভ্রান্তি। পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সবাই তখন প্রচন্ড স্নায়ু চাপে ভুগছে। ক্যালি শেলের মনে আছে, আল গোর তখন খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করছিলেন। তিনি তখন হোটেল রুমের মেঝেতে শুয়ে পুরো বিষয়টির মানে বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

এর পর মধ্যরাতের একটু পর, টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো এবার উল্টো ফল ঘোষণা করতে লাগল, তারা বলল ফ্লোরিডায় আসলে জিতেছেন জর্জ ডব্লিউ বুশ।

এ খবরে আল গোর শিবিরে যেন বিপর্যয় নেমে এলো। মনে হচ্ছিল এটি যেন এক শবযাত্রা। সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে। আড়াইটার সময় আল গোর একা তার স্যুইটের বেডরুমে গিয়ে বুশকে ফোন করলেন এবং পরাজয় স্বীকার করলেন। বুশকে অভিনন্দন জানালেন।

তখন সেখানে পিনপতন নীরবতা। কেউ কিছু বলছিল না। আমার মনে হয় সবাই একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে জেতার জন্য দেড় বছর ধরে সবাই কষ্ট করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে হারতে হলো। তার পর আল গোর যখন হার স্বীকার করে বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তার টিমের কাছে একটি বার্তা এলো।

তার দলের একজন কর্মীর কাছে একটা টেক্সট মেসেজ এলো ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের কাছ থেকে। এটিতে বলা হলো– আল গোরকে যেন অনুষ্ঠান মঞ্চে যেতে দেয়া না হয়। কারণ ভোটের লড়াই এখনও শেষ হয়নি।

কিন্তু আল গোর চাইছিলেন, তিনি মঞ্চে গিয়ে বক্তৃতা দেবেন। তিনি বলছিলেন, লোকজন বহু ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে, আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই।

‘তখন একটা লোক সবার সামনে গিয়ে বললেন, মাইক রেডি নয়। কাজেই সবাই আবার বাইরের রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এর পর লোকটা আল গোরকে বললেন, ফ্লোরিডার ব্যাপারটি এখনও শেষ হয়নি।

তখন আল গোর বললেন, কী বললে? আমার মনে আছে, তার মুখের হতবাক অভিব্যক্তি। তার পরই শোনা গেল লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। আল গোর তখন জানতে চাইলেন, আসলেই তাই? তুমি মজা করছ না তো?

সেই ফোনকলের কথোপকথন ক্যালি শেলের শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই মুহূর্তগুলো তিনি ক্যামেরায় বন্দিও করেছেন। ফ্লোরিডার সর্বোচ্চ আদালত রায় দিলেন প্রতিটি ভোট হাতে গুনতে হবে। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট এ রায় উল্টে দিলেন। সুপ্রিমকোর্টের নয় বিচারকের ৫ জন ভোট দিলেন ভোট পুনঃগণনা বন্ধ করার পক্ষে, চারজন বিপক্ষে।

আদালত ভোটের প্রথম ফলকেই সঠিক বলে রায় দিলেন। অর্থাৎ ফ্লোরিডায় জর্জ ডব্লিউ বুশই জিতেছেন। ফলে ফ্লোরিডার সব ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে গেলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। তার মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দাঁড়াল ২৭১। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যত ভোট দরকার, তার চেয়ে এক ভোট বেশি। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে আল গোরের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

ad

পাঠকের মতামত