344308

দেশে ছেলে ধ’র্ষণের বিচার কীভাবে হয়?

বাংলাদেশে সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে ধ’র্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে নির্ধারণ করে আইন পরিবর্তন করলেও আইনের ‘অস্পষ্টতা’ এবং বিচার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের ‘অজ্ঞতা’র কারণে পুরুষ ধ’র্ষণের বিচার হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে মেয়ে বা নারী ধ’র্ষণের ঘটনা বর্তমানে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জানানো হলেও পুরুষ বা ছেলে শিশু ধ’র্ষণের ঘটনার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয় না।

আইনে ‘ধ’র্ষ’ণ’এর সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা থাকার পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও এটিকে শুধু নারীর বি”রুদ্ধে হওয়া যৌ’ন অ’পরাধ মনে করা হয়, যার ফলে ধ’র্ষণের শি’কার পুরুষরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

নারী ও শিশু নির্যা’তন দমন আইন নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন। তিনি মনে করেন, যথাযথ গবেষণা এবং কেস স্টাডি পর্যালোচনার মাধ্যমে আইনে ‘ধ’র্ষণ’এর সংজ্ঞা পরিবর্তন না করলে ছেলেদের ধ’র্ষ”ণের বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ধ’র্ষণের শিকা’র হতে পারে শুধু একজন ‘নারী’, এবং (তা ঘটবে) একজন পুরুষের মাধ্যমে (দণ্ডবিধি ধারা-৩৭৫)। শুধু তাই নয়, দণ্ডবিধির সংজ্ঞাটি বলছে, ধ’র্ষণের ক্ষেত্রে যৌ’ন সঙ্গম বিবেচনা করার জন্য ‘পেনিট্রেশন’-ই (প্রবিষ্ট করা) যথেষ্ট। অথচ সংজ্ঞাটিতে কোথাও ‘পেনিট্রেশন’-এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।’

তাসলিমা ইয়াসমিন মনে করেন, সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা না থাকার কারণে অনেক সময়ই মামলায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে এমন মামলা রুজু করা হয় যেটির গুরুত্ব এবং শা;স্তি অপেক্ষাকৃত কম।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ধরেই নেয়া হয় ‘পেনিট্রেশন’ মানে নারীর সঙ্গে পুরুষের যৌ’ন সম্পর্ক। আর আইনে এই বিষয়ের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না দেয়া থাকায় অনেকক্ষেত্রেই ধ’র্ষণ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না।’

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা কঠোরভাবে দমন করতে ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল ‘নারী ও শিশু নি’র্যাতন দমন আইন’। এই আইনটিতে ‘শিশু’র যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাতে কোন লিঙ্গ বিশেষে নয় বরং ১৬-বছরের কম বয়সী যে কোন শিশুই এই আইনে বিচার পাওয়ার কথা।

ইয়াসমিন বলেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এরকম ক্ষেত্রে মামলার এফআইআর রুজু হয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায়, যেটি সমকামিতাসহ ‘প্রাকৃতিক’ নিয়মের বিরুদ্ধে করা যৌ’ন সঙ্গমকে দণ্ডনীয় করেছে।

আবার অনেকসময় এই ধরণের মামলায় অভিযোগ নারী ও শিশু নি’র্যাতন দমন আইনের ধারা-৯ এর অধীনে না করে ধারা-১০ এর অধীনে করায় ধ’র্ষণের বদলে যৌ’ন স’হিংসতার মা’মলা করা হয় এবং শা’স্তিও অপেক্ষাকৃত কম হয়।

ইয়াসমিন বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে শিশুদের যৌ’নাঙ্গে নি’র্যাতনকারীরা কলম, বোতল বা লাঠির মত বস্তু প্রবেশ করানো হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী চাইলে এরকম ঘটনার ক্ষেত্রে ‘ধ’র্ষণ হয়নি’ বলে প্রমাণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মামলাটি নারী ও শিশু নি’র্যাতন আইনের ধারা-৯ এর অধীনে না ফেলে ধারা-১০ এর অধীনে ফেলা যায়, যেটি আইনের ভাষায় ‘যৌ’ন পীড়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হবে এর শা’স্তিও ধারা-৯ এর শা’স্তির চেয়ে কম।’

ধারা ৯ বলছে, ১৬ বছরের নীচে যে কোন শিশুর সাথে যৌ’ন সঙ্গমকেই ধ’র্ষণ বলা হবে এবং শিশুর সম্মতি ছিল কিনা, তা বিচার্য হবে না।

আইনের ফাঁকফোকরের পাশাপাশি ছেলে ধ’র্ষণ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যেও ভুল ধারণা এবং বিচক্ষণতা ও দক্ষতার অভাবের কারণে বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তিনি।

ইয়াসমিন বলেন, ‘একটা ধ’র্ষণের ঘটনাস্থল থেকে কী কী আলামত সংগ্রহ করতে হবে, সেসব আলামত কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তের ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে – এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা ধারণা যেমন খুব কম পুলিশের আছে, তেমনি বিচারকদের মধ্যে অনেকেই এই ধরণের মামলার বিচারকাজ চালানোর ব্যাপারে অভিজ্ঞ নন।’

এছাড়া ধ’র্ষণ প্রমাণ করা না গেলে মামলা নারী ও শিশু নি’র্যাতন ট্রাইব্যুনালে না গিয়ে ফৌজদারি আদালতে যায়, যেসব ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়ে ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়।

তবে নারী ও শিশু ‘নি’র্যাতন আইন ২০০০-এর অধীনে ১৬-বছরের কম বয়সী ছেলে শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া ধ”র্ষণ বা যৌ’ন নির্যা’তনের বিচার হওয়ার সুযোগ থাকলেও ১৬ বছরের বেশি বয়সী পুরুষের ধ’র্ষণের বিচারের কোনো সুযোগ বাংলাদেশের আইনে নেই।

তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমাদের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে যৌ’ন সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত যতগুলো ধারা আছে, সেগুলোতে পরিষ্কার বলা রয়েছে ‘যখন একজন পুরুষ একজন নারীর’ বিরুদ্ধে যৌ’ন সহিংসতামূলক আচরণ করেন। অর্থাৎ ধরেই নেয়া হয়েছে যে একজন পুরুষ নিজে যৌ’ন আক্রমণের শি’কার হতে পারেন না। এরকম ক্ষেত্রে ধ’র্ষণ বা যৌ’ন নি’র্যাতন হলে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় মা’মলা হতে পারে। অথবা ভুক্তভোগী শা’রীরিকভাবে আ’ঘাত পাওয়ার অভিযোগ করতে পারেন।’

যার ফলে বাংলাদেশে ১৬-বছরের বেশি বয়সী একজন পুরুষ তার বি’রুদ্ধে যৌ’ন সহিং’সতা হলেও তার অভিযোগ নিয়ে আইনগতভাবে সুবিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সৌজন্য: বিবিসি বাংলা।

ad

পাঠকের মতামত