342917

নবজাতক ফেরত পেলেন টাকার অভাবে সন্তান ‘বিক্রি’ করা সেই মা

লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ টাকার অভাবে নবজাতক বিক্রি করা লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মা হাসিনা বেগম (৩৫) নবজাতক ফেরত পেয়েছেন। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে তিনি পাচ্ছেন ঘর ও ভাতা। গতকাল শুক্রবার রাতে নবজাতককে ফেরত এনে হাসিনার হাতে তুলে দেন আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।

হাসিনা বেগম উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টেপারহাট গ্রামের জোকতার আলীর স্ত্রী। তিনি একই এলাকার তালুক হরিদাস নয়াটারী গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের মেয়ে।

জানা গেছে, ১৮-২০ বছর আগে একই গ্রামের টেপারহাট গ্রামের জোকতার আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় হাসিনার। তিনি ছিলেন জোকতারের দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের কিছুদিন স্বামীর বাড়িতে থাকলেও পরে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হাসিনার ঠাঁই হয় তালুক হরিদাস নয়াটারী বাবার বাড়িতে। সংসারের খরচ বহন না করলেও স্বামী জোকতার সম্পর্ক রেখেছিল হাসিনার সঙ্গে। এরই মাঝে তার সংসারে এক মেয়ে ও দুই ছেলের জন্ম হয়। বড় মেয়ে রোসনার বিয়ে দেন।

ফুটো টিনের ওপর পলিথিন সাঁটানো একমাত্র ঝুপড়ি ঘরে দুই ছেলে হাসান ও রাসেলকে নিয়ে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হাসিনা বেগম। করোনাকালে এবং মাঠে কাজ না থাকায় বেকার কৃষি শ্রমিক স্থানীয়ভাবে ঋণ করে অনাহারে সংসার চালান তিনি। দেনা হয়ে যায় প্রায় ১০ হাজার টাকা। এরই মাঝে গত মঙ্গলবার সকালে হাসিনা বেগম একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান প্রসব করেন। অভাবের মাঝে সন্তানকে প্রতিপালনের চিন্তায় পড়েন হাসিনা। তবে তার ভাই নিঃসন্তান কেরামত আলী বোনের সন্তানকে নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কিন্তু প্রতিবেশী অধির চন্দ্র তার শ্বশুরবাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট এলাকার জনৈক দম্পতিকে সন্তানটি দিতে বলেন। এতে বাধা দেন হাসিনা ও তার বড় ছেলে হাসান। অধির চন্দ্র রাজারহাটের ওই দম্পত্তির হাতে নবজাতককে তুলে দিতে হাসিনার স্বামী জোকতার আলীকে ম্যানেজ করেন। এতে হাসিনা ও তার ছেলে রাজি না হলেও জোকতার ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে জোরপুর্বক সন্তানকে তুলে দেন রাজাহাটের ওই দম্পত্তির হাতে।

নবজাতক ভাইকে আটকানোর চেষ্টা করে বাবার গালমন্দের শিকার হন হাসান। নবজাতক বিক্রির টাকায় ঋণের ১০ হাজার পরিশোধ করেন হাসিনা। কিন্তু নাড়ি ছেড়া ধন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ছোট ভাইকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে বড় ভাই হাসান বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

এ নিয়ে শুক্রবার সকালে দৈনিক আমাদের সময়ে ‘অভাবের তাড়নায় ২০ টাকায় নবজাতক বিক্রি করলেন মা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি দেখে জেলা প্রশাসক আবু জাফরের নির্দেশে শুক্রবার দুপুরে ওই বাড়িতে যান আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) সাইফুল ইসলাম।

এ সময় বিক্রিত নবজাতককে ফেরত নিয়ে আসতে দাতাকে ফোনে জানানো হলে রাতে নবজাতককে ফেরত নিয়ে আসেন গ্রহণকারীরা। এরপর রাতে পুনরায় হাসিনার বাড়িতে যান ইউএনও এবং ওসি। তারা সেই নবজাতককে গ্রহণ করে হাসিনার বেগমের হাতে তুলেন দেন।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হাসিনা বেগম বলেন, ‘ছাওয়া (নবজাতক) ফেরতসহ নগদ টাকা পাইলাম এবং ভাতা ও ঘর দিবার চাইছে। যারা এসব দিলো আল্লায় তাদের ভালো করবে।’

মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রশাসনকে সহায়তা করায় সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদন দেখে নবজাতককে ফেরত নিয়ে এসে হাসিনা বেগমের কোলে তুলে দিয়েছি। একই সঙ্গে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মহোদয়ের পক্ষে নবজাতকের জন্য ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।’

শুধু তাই নয়, হাসিনাকে প্রতিবন্ধী ভাতাভুক্তসহ তাকে এবং তার ভাই কেরামতকে ঘর করে দেওয়া হবে। নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও কোন প্রয়োজন হলে সরকারিভাবে সহায়তা করা হবে বলেও জানান আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

ad

পাঠকের মতামত