340346

চীন-মার্কিন স্বার্থই মিয়ানমারকে রক্ষা করছে!

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নি’র্যাতন,জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গ’ণহ’ত্যার চেষ্টা আইনের শাসনের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন, সুস্পষ্ট নৃ’শংস’তা এবং একজন শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক আইনজীবীর মতে, আমাদের সামষ্টিক বিবেক ও মানবতার ওপর নৈতিক ক’লঙ্ক। ফলে ফলে পরিচিত লঙ্ঘনকারীরা শা’স্তিহীন থেকে যাবে আর হ’ত্যাকা’ণ্ড ও অন্যান্য নৃ’শংস’তা অব্যাহত থাকবে? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব আছে কয়েকটি। সম্ভবত গরিব, নিঃসঙ্গ মিয়ানমার দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো, পাশ্চাত্যের অবচেতন মনে অনেকটাই অদেখা, অপরিচিত, বাদামি চামড়ার মুসলিম সং’খ্যাল’ঘুদের জীবন নানামুখী বর্ণগত, জাতিগত ও উদ্বাস্তু স’ঙ্কটে তেমন মূল্যবান নয়।

কিংবা হয়তো যুগ-প্রাচীন একটি সমস্যা থেকে বড় ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি না হওয়াও কারণ। মিয়ানমার এক শ’ বছরের বেশি সময় রাজকীয় ব্রিটেনের আওতায় ছিল। এখন তারা আছে রাজকীয় চীনের অধীনে। আর এই চীন দেশে বা বিদেশে মানবাধিকারের থোরাই কেয়ার করে। মিয়ানমারের এই সমস্যার মূলে আছে তাতমাদাও তথা দেশটির সামরিক বাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত, নির্যাতনমুখী শক্তি। দেশটিতে ২০১১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও এই বাহিনীই জাতীয় জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ২০১৬-১৭ সময়কালে রোহিঙ্গাদের ওপর হা’মলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হ’ত্যা এবং ১০ লাখের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। এটি সারা দুনিয়ায় শোকের সৃষ্টি করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।

গত সপ্তাহে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ হাই কমিশনার মাইকেল বেচেলেট হুঁ’শিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে নৃ’শংসতা’ বন্ধ করার পর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আবার রাখাইন ও প্রতিবেশী চিন রাজ্যে দায়মুক্তি নিয়ে হ’ত্যা ও অ’পহরণ চালাচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা নির্বিচারে হা’মলা চালায়। আর তা মানবতার বি’রুদ্ধে আরো অপ’রাধ হচ্ছে। কিন্তু এরপরও কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী আং সান সু চি হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) হাজির হলে বিচারের আশা জেগেছিল। কিন্তু সু চি প্রফুল্ল চিত্তে গ’ণহ’ত্যার উদ্দেশ্য থাকার কথা খারিজ করে দিয়ে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে বলেন যে রাখাইনে সেনাবাহিনী, রো’হিঙ্গা জ’ঙ্গি ও স’শস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে। তিনি বলেন, সৈনিকদের কেউ ব্যক্তিগতভাবে অ’পরাধ করে থাকলে তাকে শা’স্তি দেয়া হবে।

জানুয়ারিতে আইসিজে তার অন্তর্বর্তী রায়ে মিয়ানমার নেতৃত্বকে গ’ণহ’ত্যা প্রতিরোধে দেশের আইনগত বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও রোহিঙ।গাদের হ’ত্যা বা ক্ষ’তি করা বন্ধ সব পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। আদালত অ’পরা’ধের প্রমাণ ধ্বং’স না করার জন্য মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দেয় এবং আদালতের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলে। আদালত তার অনুসন্ধান জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানোর কথা বলেন।

এর কোনো বাস্তব প্রভাব পড়েনি। বেচেলেট বলেন, হ’ত্যাকা’ণ্ডের মাত্রা বরং বেড়েছে। উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, সামরিক বাহিনী তিন বছর আগে জ্বা’লিয়ে দেয়া কান কিয়া গ্রাম মাটির সাথে মিশিয়ে নামটি মুছে ফেলেছে মানচিত্র থেকে। কর্তৃপক্ষ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেনি। তারা অপরাধের কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তও করেনি।

এদিকে রাখাইন অ’ভিযানে অংশ নেয়া দুই সৈন্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আরো খারাপ আ’শঙ্কা নিশ্চিত করেছে। সামরিক বাহিনী কিভাবে গ’ণহ’ত্যা চালিয়েছে, গণকবর দিযেছে, গ্রাম জ্বা’লিয়ে দিয়েছে, নারী ও বালিকাদের ধ’র্ষণ করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। জাও নাইঙ তুন বলেন, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে বলেছেন, যাকে দেখবে, সবাইকে হ’ত্যা করবে, তা শিশু বা বয়স্ক, যেই হোক।

এদিকে সহিং’সতার সাম্প্রতিক বৃদ্ধি ও এখনো বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের দুর্দশার প্রেক্ষাপটে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের আট সদস্য আইসিজের দাবি মেনে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাছাড়া নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে রোহিঙ্গা ভোটাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ারও আহ্বান জানানো হয়। এই যৌথ বিবৃতি চীনের ভেটো এড়িয়ে যেতে পারাটা একটি অগ্রগতি। তবে প্রেসার গ্রুপ বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে জানিয়েছে, এটি স্রেফ প্রস্তাব ছিল। কোনা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়নি।

গত বছর জাতিসঙ্ঘ ইন্ডিপেডেন্ট তথ্যানুসন্ধান মিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে না পারাটাও বিস্ময়কর নয়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোকে তাদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলতে বলা হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মিয়ানমার পূর্ণ বৃত্তে চলে এসেছে। ব্রিটিশরা যেভাবে বার্মাকে অধীনে রেখে দেশটির সম্পদ শোষণ করেছিল, এখন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রধান মদতদাতা চীন ঠিক তাই করছে। চীনের লক্ষ্য মিয়ানমারকে প্র’তিদ্বন্দ্বী আমেরিকা, ভারত ইত্যাদি দেশ থেকে টেনে এনে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মিয়ানমার সফরে প্রধানত অবকাঠামো খাতে অনেক চুক্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল চীন-বাংলাদশ অর্থনৈতিক করিডোর। এই করিডোরের মাধ্যমে চীন সরাসরি বঙ্গোপসারে প্রবেশ করতে পারবে। এটি হবে বি’রোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগর ও মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে চীনা বাণিজ্য অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা।

চীনের আরো ঘনিষ্ঠ বন্ধন, ঋণ ফাঁদ ইত্যাদির বিপদ সম্পর্কে মিয়ানমারের শাসকেরা বিস্মৃত নয়। তবে বেইজিংয়েল রাজনৈতিক সমর্থন, জাতিসঙ্ঘের সাজা থেকে জেনারেলদের রক্ষা করার ফলে তারা দায়মুক্তি সুবিধা পেয়ে চলেছে। লাভজনক ব্যবসার সুযোগ হারানো ও এশিয়ার নতুন স্নায়ুযুদ্ধে একটি ঘুঁটি খোয়ানোর আশঙ্কায় মানবাধিকারের ব্যাপারে শক্তভাবে চাপ দিতে ভয় পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।

ফলে হ’ত্যাকা’ণ্ড অব্যাহত রয়েছে, অযৌক্তিক চাপ ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে একটি প্রবাদবাক্য নতুন করে বলতে হয় : পরাশক্তি প্রতিবারই আইন আর মানবাধিকারের তুর্যনিনাদ করে।

সূত্র : গার্ডিয়ান

 

ad

পাঠকের মতামত