340078

বিয়ের পরই কানাডা, সঙ্গে দুইশ কোটির ব্যবসা

কানাডায় প্রতিষ্ঠিত ডিভোর্সি নারী ব্যবসায়ীর জন্য ‘পাত্র চাই’- এমন বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন পুরান ঢাকার ৭০ বছর বয়সী এক ব্যবসায়ী। তার পর গুলশান ২-এর একটি থাই রেস্টুরেন্টে পাত্রীর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কানাডায় নিয়ে যাওয়া, নাগরিকত্বের আবেদন করাসহ নানা কৌশলে তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। শুধু তিনিই নন, ৩৮ বছর বয়সী বহুরূপী ওই প্রতারক নারীর ফাঁদে পড়ে অনেকেই খুইয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। বিয়ের পর কানাডায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি হাতিয়েছেন ৩০ কোটি টাকার মতো। অবশেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে ধরা পড়েছেন প্রতারক নারী সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস। রাজধানীর বনানী সুপার মার্কেট এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেপ্তার করে। সাদিয়ার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়।

সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার জানান, সাদিয়া জান্নাত ও তার স্বামী মো. এনামুল হাসান সংঘবদ্ধভাবে এ প্রতারণা করে আসছিলেন। ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তারা এ কাজ করছেন ২০১৫ সাল থেকে। সাদিয়াকে গ্রেপ্তারের পর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ছাড়া আরও সাত ভুক্তভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছেন, একইভাবে তাদের কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিন ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট, ১০টি মুঠোফোন, সাতটি সিল, ব্যবহৃত অসংখ্য সিম, হিসাবের খাতা এবং বেসরকারি একটি ব্যাংকে ৪৮ লাখ টাকা জমা দেওয়ার রশিদ উদ্ধার করা হয়েছে সাদিয়ার কাছ থেকে।

ডিআইজি শেখ রেজাউল আরও জানান, পোশাক-আশাক এবং কথাবার্তায় আধুনিকতার ছাপ থাকায় কানাডা প্রবাসী বলে লোকজনের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হন সাদিয়া জান্নাত। অথচ তিনি মাধ্যমিকও পাস না। প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার পরই প্রতারণার এ কাজ শুরু করেন সাদিয়া। ঢাকা এবং এর আশপাশে এখন পর্যন্ত তাদের ২০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, এই চক্রে সাদিয়া জান্নাতের স্বামী ছাড়াও শাহরিয়ার, ফারজানা ও আবু সুফিয়ান নামে আরও তিন ব্যক্তি যুক্ত রয়েছেন। এর মধ্যে সাদিয়ার কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে প্রতারিত হওয়া আরও অনেকের নাম, ফোন নম্বর এবং তাদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার পরিমাণ উল্লেখ রয়েছে ওই ডায়েরিতে। এখন পর্যন্ত চারটি ব্যাংকে প্রতারক ওই নারীর কোটি টাকার সন্ধান মিলেছে। এসব অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধ রাখতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পরবর্তী সময় আদালতের অনুমিত নিয়ে সেগুলো জব্দ করা হবে।

যেভাবে ফাঁদে ফেলে নেওয়া হয় অর্থ-সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ‘পাত্র চাই’ বিভাগে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়- ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি সন্তানহীন নামাজী পাত্রীর কানাডার ব্যবসার দায়িত্ব নিতে ব্যবসায়ী পাত্র চাই।’ এ বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে কানাডা যাওয়ার আশায় সাদিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন অনেক ব্যবসায়ী। তার পর তার মিষ্টি কথার জালে আটকা পড়ে প্রতারিত হন।

পুরান ঢাকার বৃদ্ধ ব্যবসায়ী এভাবেই ফাঁদে পড়েছেন জানিয়ে সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, সাদিয়ার সঙ্গে ওই ব্যক্তির প্রথম সাক্ষাৎ হয় গত ১২ জুলাই। এর পর দেড় মাসের ব্যবধানে তিনি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেন। কিন্তু কখনই ভাবেননি তিনি প্রতারিত হচ্ছেন। গত ১ সেপ্টেম্বর সাদিয়া ‘ডলারের বাক্স’ বলে তার হাতে এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজের একটি বাক্স ধরিয়ে দেন। সেটি খুলেই তিনি বুঝতে পারেন, মিষ্টি কথার জালে ফেঁসে গেছেন। এরই মধ্যে খুইয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। তার পরই গুলশান থানায় মামলা করেন ভোজ্যতেলের ওই ব্যবসায়ী। বিপত্নীক ওই বৃদ্ধের দুই ছেলে রয়েছেন।

মামলার এজাহারের বাদী জানিয়েছেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ১২ জুলাই গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে প্রথম সাদিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয়। তখন ওই নারী জানান, কানাডায় তার ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা আছে। তিনি এবং তার এক ভাই মিলে দেখাশোনা করেন। আলাপের একপর্যায়ে সাদিয়া পাত্র হিসেবে তাকে পছন্দ হয়েছে এবং বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে যাবেন বলে জানান। কথা অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ী তিন দিন পর গত ১৫ জুলাই সাদিয়াকে তার পাসপোর্ট দেন। এর পরই শুরু হয় টাকা নেওয়া। কানাডার ভিসার আবেদনের জন্য প্রথম তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন ওই নারী। ভিসার জন্য আরও ৭০ হাজার টাকা নেন। নগদ সেই টাকা দেওয়ার পর ট্রাভেল ডকুমেন্টস তৈরি করা বাবদ আইনজীবীকে দেওয়ার জন্য নেন আরও ছয় লাখ টাকা। এর পর ‘কানাডার সোশ্যাল সিকিউরিটির’ জন্য নেন ৬০ লাখ টাকা। ১২ আগস্ট সেই টাকা নেওয়ার পর রাতে সাদিয়া তাকে ফোন করে বিভিন্ন লোভ দেখাতে থাকেন। বৃদ্ধও তার মিষ্টি কথায় ভুলে যান। এর পরই সাদিয়া আরও বড় ফাঁদ পাতেন, ব্যবসায়ীকে বলেন, কানাডায় শীত বেশি হওয়ায় সেখানে তিনি টিকতে পারবেন না। বরং সেখানে ব্যবসায় খাটানো তার ২০০ কোটি টাকা ফেরত এনে দেশেই দুজন মিলে ব্যবসা করলে ভালো হয়। ব্যবসায়ী সেই প্রস্তাবেও রাজি হন। তাই কানাডা থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাট দেওয়ার কথা বলে ২৩ লাখ টাকা নেন সাদিয়া। এর পর জানান, বাংলাদেশ সরকার টাকা আনার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু কানাডা দেয়নি। সে জন্য কানাডা সরকারকে ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে। সেই টাকা নেওয়ার পর সাদিয়া তার কাছ থেকে আরও ১০ লাখ টাকা নেন, সেটি ২০০ কোটি টাকা আসার কুরিয়ার ফি বাবদ। এভাবে সর্বমোট ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারক ওই নারী।

এর পর গত এক সেপ্টেম্বর গুলশান-২ নম্বরের একটি বিদেশি বহুজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ের ভেতর থেকে একটি বক্স এনে তার হাতে ধরিয়ে দেন। সেখানে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ডলার আছে জানিয়ে সেটি বাসায় নিয়ে খুলতে বলেন সাদিয়া। তার কথামতো বাসায় এসে ব্যবসায়ী যখন বক্সটি খোলেন তখন সেখানে এ-ফোর সাইজের পাঁচশটি সাদা কাগজের একটি বান্ডিল পান।
সূত্রঃ দৈনিক আমাদের সময়

ad

পাঠকের মতামত