339838

ডোনাল্ড ট্রাম্প দানব, কিন্তু বাইডেন তার চেয়েও বড় দানব

হামিদ দাবাশি : সময় গড়িয়ে আবারও এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আবারো ত’র্ক শুরু হয়েছে ‘অতি-প্রগতিশীলদের’ মাঝে অধিকার, মানবাধিকার আর নীতি বাক্যের নানা বিষয়াদি নিয়ে। ট্রাম্পের মত দু’ষ্ট লোক এবং তার দু’র্নী’তিগ্র’স্ত পরিবারের হাত থেকে র’ক্ষা পেতে কেউ কেউ ‘অতি-লিবারেল’ করপোরেটবাদি জো বাইডেনকে ভোট দেয়ার জন্য বন্ধুদের অনুরোধ করতে পারেন।

কিন্তু জো বাইডেন কতটা উপকারী হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা তিনি ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালেই দেখা গিয়েছে। তাই তাকে এই নির্বাচনে জয়ী করে প্রসিডেন্ট নির্বাচিত করা মানে পুরাতন ফ্ল’প সিনেমা আবারো দেখার আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয়। মার্কিন হা’স্যরসা’ত্মক সিনেমা ‘গ্রাউন্ডহোগ ডে’ এর মতো ঘ’টনা খানিকটা। আমরা যেই সিনেমাটি দেখেছি ট্রাম্প আর হিলারি ক্লিন্টনের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ল’ড়া’ইয়ের সময়।

ওই একই সিনেমা ২০২০ সাল ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জো বাইডেনের ল’ড়াইয়ের সময়ও চালানো হলে সেটি দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। কিন্তু সেটিই করা হয়েছে। তাই এই সিনেমাটি দ্বিতীয়বার আপনার দেখতে ভালো লা’গুক আর না লা’গুক যেহেতু চালানো হয়েছে সেহেতু দেখতেই হচ্ছে। অর্থাৎ জো বাইডেন বা ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের মধ্য থেকে যদি কাউকেই ভালো নাও লাগে, তবুও তাদের একজনকে বেছে নিতেই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

কারণ বিক’ল্প আপাতত নেই। তৈরির সময়ও নেই। তাই আমি মার্কিন জনগণের প্রতি এই মিরা’কলে পড়ার কারণে সহানুভূতি জানাই। অ্যামেরিকান-আফ্রিকান দার্শনিক করোনেল ওয়েস্ট বললেন, আমি ফ্যা’সিবা’দবিরো’ধী একটি নির্বাচনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ভোট দিতে চাই। বাইডেনের নানা কার্যক্রম নিয়ে তার আ’প’ত্বি থাকার পরও। দার্শনিক ওয়েস্ট জানেন বাইডেন তার দেয়া সব প্রতিশ্রুতি ভ’ঙ্গ করবে।

ওয়েস্ট এটাও জানেন যে তার খুব পছন্দের কিছু বিষয় নিয়েও বাইডেন তু’চ্ছ তা’ছিল্য করতে পারে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর। তারপরও তিনি বাইডেনকেই ভোট দেবেন। কারণ দার্শনিক ওয়েস্ট ট্রাম্পকে বাইডেনের চেয়েও বেশি অপছন্দ করেন। বিশ্ববিখ্যাত ভাষাবিদ এবং রাজনৈতিক সচেতন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির বেলায়ও একই ঘ’টনা। তিনি বাইডেনের পক্ষে ন’জিরবি’হী’ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

এসব ঘ’ট’নায় যাই বোঝানো হোক না কেন ট্রাম্প বা বাইডেন কেউই মার্কিনদের খুব প্রত্যাশিত প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। এদের কাউকেউ বিশ্বাস করা যায় না। এটা নোয়াম সমস্কি ভালো করেই জানেন। কিন্তু চমস্কি বাইডেনকে সমর্থন দিলেও তিনি একবার বাউডেনের আবার ট্রাম্পের ক’ঠো’র স’মালো’চনা করছেন। এটাকি পছন্দের পরিবর্তন, নাকি শুধুই হ’তা’শা? বি’প্ল’বি নারী এক্টিভিস্ট ও চিন্তাবিদ এনজেলা ডেভিস জো বাইডেনকে সমর্থন দিচ্ছেন।

ডেভিস ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইল ব’য়ক’ট আ’ন্দো’লনের প্রথম সারির নেত্রী। তিনি বলছেন, বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিতিয়ে আনাটা গুরুত্বপূর্ণ। সত্যিই কি তাই? কিন্তু বাইডেনতো ইসরাইল ব’য়ক’ট আ’ন্দো’লন সমর্থন করেন এবং ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি দেখান এমন এক্টিভিস্টদের দু’চোখে দেখতে পারেন না। তবুও বাইডেনকে সমর্থন দিচ্ছেন কারণ ডেভিসরা র্বণবাদ, অ’ভ্য’ন্তরী’ণ স’ন্ত্রা’সবা’দ, ব’ন্দু’কযু’দ্ধ আর বেকা’রত্বের ইস্যুতে একটি অ’ন্ধ’কার জগত তৈরি করা ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে পারছেন না।

তাই যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা একটি বড় ধ’রণের দ্বি’ধার মধ্যে রয়েছেন। বলা যায়, তারা একটি ভে’ঙ্গে পড়া ভবন থেকে লা’ফিয়ে পড়ে আরেকটি ধ্বং’সস্তু’পে পরিণত হওয়া ভবনে গিয়ে উঠছেন। কারণ তারা আশা করছেন বাইডেন তাদের দেয়া সব প্রতিশ্রুতি পুরণ করবে। তাই আমি পরিষ্কারভাবে বলছি আমি বাইডেনকে ভোট দেব না। এর মানে এই নয় যে আমি তাদের চেয়ে মার্কিন রাজনীতি সম্পর্কে কম চিন্তা করছি। অথবা আমি ট্রাম্পের আরেকটি বি’প’র্য’য়কর আমলের বিষয়ে সচেতন নই।

কেউ এমন ভাবলে সেটি হবে ভুল। আমি ট্রাম্পকে ভোট দেব। ট্রাম্পের অ’ভিবা’সন নীতিতে মার্কিন নাগরিক হিসেবে আমার এবং হাজার হাজার শিশুর জীবন অনি’শ্চ’য়তার দিকে ঠেলে দেবে। তার পরও। কিন্তু বাইডেনকে ভোট দেয়া না দেয়ার বিষয়ে এখন খুব জো’র প্রচারণা চালানো উচিত। তবে আমি মনে করি আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন যে, জায়ানবাদি বাইডেন যখন ইরাক যু’দ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন তখন তাকে কোনোভাবেই ভোট দেয়া যায় না।

কারণ তিনি মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হ’ত্যা সমর্থন করেন। নির্বাচিত হলে পৃথিবীজুড়ে আরো অনেক র’ক্তক্ষ’য়ী যু’দ্ধের জন্ম দিতে পারেন ইসরাইলের স্বার্থে। সেখানে মার্কিন স্বার্থ এবং সুনাম ব্যা’পকভাবে ক্ষু’ন্ন হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাদের অনেকেরই খুব পছন্দ ছিল বার্নি স্যান্ডার্সকে। কিন্তু তার সম্ভাবনাকে সু-পরিক’ল্পি’তভাবে বিনষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এতে করে বাইডেনের সুযোগ তৈরি হয়েছে বেশি।

আমরা যদি এখন ট্রাম্প আর বাইডেনের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নেই তবে সামনে বড় একটি বি’প’দ অপেক্ষা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। সেটি হচ্ছে আগামীতে আমাদের অবশ্যই ইভানকা ট্রাম্প (ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে) ও সেলসি ক্লিনটন (হিলারি ক্লিন্টনের মেয়ে) থেকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। আর তখন মার্কিন গণতন্ত্র একটি ভ’ঙ্গুর প্র’ক্রি’য়ার মধ্যে চলে যাবে। সেখান থেকে ফিরে আসা কখনো সম্ভব নাও হতে পারে।

ব্লা’ক লাইভ মেটারস, কৃষ্ণা’ঙ্গ হ’ত্যাসহ সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘ’টনাকে সামনে এনে ট্রাম্পেকে কা’ঠগ’ড়ায় দাঁড় করিয়ে কোনোভাবেই হিলারি বা বাউডেনকে দেবতার আসনে বসানো যায় না। কারণ তারা গোটা পৃথিবীজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে ন’র’ক তৈরি করে রেখেছে সেখান থেকে ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি বারাক ওবামা একটি বক্তব্যে বলেছেন বাইডেনকে ভোট দেয়ার জন্য।

সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ। তার মানে হচ্ছে এই ভোট বাইডেনের পক্ষে যতটা তার চেয়ে বেশি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ বাউডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য কতটুকু সেটি উঠে আসছে না। আসছে ট্রাম্পকে থামাতে হলে একটি বিকল্প দরকার। আর সেটি বাইডেন। এভাবে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জাতির জন্য দুঃখজনক। কারণ আমরা যদি ওবামার যুক্তি মেনে নেই তবে আদতে যোগ্য কোনো প্রেসিডেন্ট পাচ্ছি না। না ট্রাম্প না বাইডেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ব’ন্দু’ক হা’মলার কয়েকটি ঘ’টনা উল্লেখ করে ওবামা প্রচুর কা’ন্নাকা’টি করেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ শিশুকে নি’র্ম’মভাবে হ’ত্যার জন্য তিনি কোনো রকম দুঃ’খি’ত নন। ওই জাতিগুলোর উপর চা’পিয়ে দেয়া যু’দ্ধের জন্য বরং তিনি তার দলে প্রশংসিত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হা’ম’লায় নিহ’তরা মানুষ, কিন্তু ওবামার চোখে ফিলিস্তিন আর ইরাকের মানুষরা শুধুই সংখ্যা, আর ডেমো’ক্রেটদের ক্ষ’মতা দ’খলের ট্রামকার্ড।

তাই আমি বলছি ওবামা আর বাইডেন আর যাই হোক অন্তত মানবিক মানুষ নন। তাই বাইডেনকে ভোট দেয়া মানে হচ্ছে ইসরাইলকে ফিলিস্তিনিদের হ’ত্যার জন্য অ’স্ত্র দেয়া। আবার ট্রাম্প ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতসহ আরব বিশ্বের চু’ক্তিতে মধ্য’স্থতা করছেন। তার মানে এতদিন যাবত নি’রি’হ ফিলিস্তিনিদের যেভাবে হ’ত্যা করা হয়েছে সেটিকে বৈ’ধ’তা দেয়া হলো। তাই স্বী’কার করছি ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন দা’নব, অমা’নবিক কিন্তু বাউডেনও তাই, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। তাই আমার মতো মানুষের জন্য মার্কিন নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য আদতে কোনো প্রার্থী নেই।

পলি’টিক্স অ্যাজ ভোকে’শন (১৯১৯) এর বিখ্যাত প্রবন্ধে বিশিষ্ট জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার একটি জ’টিল সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধ’রেন। এটি “দায়িত্বের নী’তিশা’স্ত্র” এবং “চূ’ড়া’ন্ত পরি’ণতির নী’তিশা’স্ত্র” এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য করেছিল। যা আজ অবধি রাজনীতিতে নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওয়েবার আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ”এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে দায়ি’ত্বজ্ঞা’নহী’নতার সাথে সুবি’ধাবা’ধিদের মধ্যে কোনো ত’ফাৎ নেই।”

কিন্তু এ বিষয়গুলো ভোটারদের মধ্যে কেউ খুব একটা আমলে নেন না। ট্রাম্পকে যদি এখানে আমি দায়ি’ত্বজ্ঞা’নহী’ন বলি তবে বাইডেন একজন সুবিধাবাদি। এ ধ’রণের মানুষের আ’চ’রণের মধ্যে একটি চূড়া’ন্ত বি’পরী’ত দিক ল’ক্ষ্য করা যায়। যা ট্রাম্প এবং বাইডেন দু’জনের মধ্যেই রয়েছে। এ ধ’রণের মানুষ শেষ পর্যন্ত অনৈ’তিক’তাকেই চলার পথ হিসেবে বেছে নেয়। আর অনৈতিক মানুষ কখনো নেতা হিসেবে নি’রা’পদ হতে পারে না।

মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে সচেতন মানুষরা এখন ট্রাম্প আর বাইডেনের মধ্যে কে কম ম’ন্দ সেটি নিয়ে আলোচনা করছেন। কিন্তু এটা কখনো সমাধাণ হতে পারে না যে আমি দু’জন খা’রা’প মানুষ থেকে যাকে আমার কম খা’রা’প মনে হবে তাকে ভোট দেব। খারাপ সব সময়ই খা’রা’প, সেটি কম বা বেশি হোক। যেমনটি আমি প্রায় চার বছর আগেও যু’ক্তি দিয়েছিলাম যে, যখন ট্রাম্প এবং হিলারির মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হয়েছে। তখন আমি বলেছিলাম এই দুই শ’য়’তান থেকে বা এরকম শ’য়’তানদের থেকে মার্কিন গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে।

বিষয়টা এখন এমন যে ৩০০ মিলিয়ন মানুষকে নিজের স্বাস্থ্যের জন্য কোক অথবা পেপসি থেকে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হচ্ছে। অথচ এর কোনোটিই স্বাস্থ্যকর পণ্য নয়। এসবের পরিবর্তে একটি স্বাস্থ্যকর পণ্য যেমন বেছে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ট্রাম্প বা বাইডেন থেকে যেকোনো একজনকে বেছে না নিয়ে সত্যিকারের একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তৈরি করতে মার্কিন জনগণকে কাজ করতে হবে। লেখক: হামিদ দাবাশি, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ এবং কম্পারেটিভ লিটারেসি’র অধ্যাপক। সূত্র : আল-জাজিরা

ad

পাঠকের মতামত