338546

যে ভুলে চীনের কাছে হারছে ভারত

ভারতের চীন স্ট্র্যাটেজি গত ১০ মাস ধরে অস্থিতিশীল বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, চীনকে সংযত করার জন্য পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করে মারাত্মক যন্ত্রণার মুখে রয়েছে।লাদাখে চীন-ভারত দীর্ঘ সময় ধরে চলা অচলাবস্থা নয়া দিল্লির অস্থিরতা সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে।

ভারতের সাম্প্রতিক চীন কৌশল নিয়ে প্রকাশ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ষোড়শ লোকসভা তথা ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের পররাষ্ট্র দফতরের কমিটিতে দাখিল করা টুয়েন্টি-সেকেন্ড রিপোর্ট এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বক্তৃব্যে ভারতের নতুন চীন কৌশলের রূপরেখা পাওয়া যায়।
জয়শঙ্কর চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে পাশ্চাত্যমুখী নীতি গ্রহণে প্রবলভাবে আগ্রহী। ২০১৯ সালের মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি তার ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ পেয়েছেন।
গত ১০ মাসে ভারতের চীন কৌশল চারটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে।
প্রথমটি হলো নীতি পরিত্যাগের ধাপ। জয়শঙ্কর প্রবলভাবে এই ধারণায় বিশ্বাসী যে পাশ্চাত্যের সাথে মিত্রতা গড়ার মাধ্যেই কেবল ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য পূরণ হতে পারে। তিনি যখন ভারতের পররাষ্ট্র সার্ভিসে যুগ্মসচিব, তখন থেকেই এই ধারণা পোষণ করে আসছে।

জয়শঙ্কর তার বস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাশ্চাত্যপন্থী নীতিতে পরিচালিত করতে অনুপ্রাণিত করছেন।
দ্বিতীয় ধাপটি হলো ঝুঁকি গ্রহণে প্রস্তুতি পর্ব। তামিল নাড়ুতে ২০১৯ সালের ১১-১২ অক্টোবর মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকের পর জয়শঙ্কর চীনের বিরুদ্ধে ঝুঁকি গ্রহণ নীতি গ্রহণ করেন।

তিনি ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর কূটনীতিক, কৌশলবিদ, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সামনে এক আলোচনায় এ ব্যাপারে রূপরেখা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ফলপ্রসূ ছিল না। এবং এর কারণ হলো তা পুরোপুরি পাশ্চাত্যমুখী ছিল না। তার মতে, পূর্ববর্তী সব ভারতীয় সরকারই ছিল প্রকৃতির দিক থেকে ঝুঁকি এড়িয়ে চলার পক্ষে। তিনি দাবি করেন, এই নীতির ফলে ভারত অনেক ভুগেছে। তিনি জোরালোভাবে বলেন, ভারতকে অবশ্যই বড় ধরনের লাভের জন্য কৌশলগত ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে।

তৃতীয় ধাপ হলো, ভারতের কৌশলগত অবস্থান বাস্তবায়ন করা ও তাতে অটল থাকা।এর ফলে ভারত তার দীর্ঘ দিনের লালিত জোট নিরপেক্ষ নীতি পরিত্যাগ করে, পাশ্চাত্যের দিকে ঝুঁকতে বিপুল ঝুঁকি গ্রহণ করে।
এই নীতির প্রেক্ষাপটেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারত ২+২ সংলাপে যায়। এতে দুই দেশর পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা আলোচনায় বসে। ২০১৯ সালের সংলাপে জয়শঙ্কর ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার অংশ নেন।

এই আলোচনায় দুই পক্ষ আইএসএ, জিএসওএমআইএর মতো চুক্তিতে সই করে। এসব চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে উচ্চমাত্রার প্রযুক্তি হস্তান্তর ও গোপন সামরিক তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় থেকে দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতা আরো ত্বরান্বিত হয়।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালে এলইএমওএ ও ২০১৮ সালে সিওএমসিএএসএ চুক্তিও সই করে।
আর কোভিড-১৯ মহামারির সময় চীন-ভারত প্রথম ও দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের সব সমঝোতা ও চুক্তি বাতিল করে দেয়।তাইওয়ান বিরোধ, দক্ষিণ চীন সাগর, হংকংয়ের মতো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে ভারত। তাছাড়া কারোনা ভাইরাসের উৎপত্তি ও বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ীও করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে অবস্থান নিয়ে।

চীনা কৌশলবিদেরা মনে করতে থাকেন যে কোভিড-১৯-এর ফলে চীনের নাজুক অবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি যুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ আগ্রহী হয়ে ওঠেছে ভারত। চীনারা মনে করতে থাকে, চীন সমস্যায় আছে, এটা ভেবে ভূখণ্ডগত ফায়দা হাসিলের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
চীন আরো মনে করতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ ও কোভিড-১৯ মহামারির সুযোগে চীনের পিঠে ছুরি বসাতে চায় ভারত।

তবে ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে চীন কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। চলতি বছরের ৮ মে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যরা মুখোমুখি হয়।উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে একজন কমান্ডিং অফিসারও ছিলেন। চীনাদের পক্ষে কতজন মারা গেছে তা জানা যায়নি।
প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ৪৯টি চীনা অ্যাপস নিষিদ্ধ করে ভারত। এছাড়া ভারতব্যাপী চীনা পণ্য বয়কটের প্রচারণাও চলে।

সর্বশেষ ধাপটি হলো ভারতের সমতা কামনা করা। ভারতীয় কৌশলবিদেরা মনে করেছিল লাদাখ থেকে চীনা সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত সরে যাব্ কিন্তু চীনা সৈন্যরা এই বার্তা দিয়েছে যে তারা তাদের মূল স্বার্থের সাথে আপস করবে না। সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো তাড়াহুড়া নেই চীনাদের।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনার প্রথম পর্বে ইতিবাচক ঘটনা ঘটায় এবং চীন তথাকথিত ক্যারিয়ার কিলার, ডিএফ-২১ডি ও ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে পরীক্ষা করায় ভারত আরো নার্ভাস হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরামের আয়োজিত এক ইভেন্টে বক্তৃতাকালে জয়শঙ্কর বলেন, চীন ও ভারতের প্রয়োজন আকার ও জনসংখ্যার আলোকে সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ধারাবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সমঝোতায় পৌঁছানো।

ভারত এখন সাম্য চায়, কিন্তু তা পাবে না। ভারত ইতোমধ্যেই চীনকে সুবিধা দিয়ে ফেলেছে। ফলে চীন আর এ ধরনের সাম্যে যাবে না। সীমান্তে সামরিক অচলাবস্থা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ভারত তত চাপে থাকবে। পাশ্চাত্যের দিকে তাকাতে তাকাতে ভারত ট্রেন মিস করেছে, ভারতের চেয়ে চীন অনেক এগিয়ে গেছে।
এশিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিন্যাসে চীন নিজেকে শীর্ষস্থানে দেখতে চায়, অন্যদের তার পেছনেই দেখতে চায়।

ভারতীয় কৌশলবিদেরা হয়তো ভাবছেন যে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় প্রান্তবর্তী এলাকায় ভারত হলো রাজা। কিন্তু চীনা কৌশলবিদেরা ভারতকে ঘুঁট মনে করে। রাজা অবস্থান করছে অন্য কোথাও, ভারত তার কৌশলগত স্বার্থ পূরণের জন্য ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, লিভার ব্যবহার করে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবলম্বনের কাছে থাকা ব্যক্তিটিকে অবশ্যই অবলম্বন থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিটির চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও এই সূত্রটি প্রযোজ্য। ভারতের তাই সমতা অর্জন করতে হলে বাড়তি শক্তি ব্যয় করতে হবে।

এই কৌশলগত খেলায় ভারতের হাতে দুটি কৌশলগত বিকল্প আছে। একটি হলো চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত হওয়া কিংবা দ্বিতীয়টি হরেঅ চীনের সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে সম্মত হওয়া সমঝোতাগুলো বাস্তবায়নে চীনা দাবি মেনে নেয়া।

ভারত ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে (এপ্রিল-জুন) জিডিপি ২৩.৯ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলোর জিএসটি ক্ষতিপূরণ মেটাতে পারেনি। ফলে ভারতের ফেডারেলবাদ ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। ভারত কিভাবে যুদ্ধের অর্থ প্রদান করবে, তা একটি বড় প্রশ্ন।

চীনেরও দুটি কৌশল রয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কিংবা সীমান্ত অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত করা। বর্তমান চীন-ভারত কৌশলগত খেলা চীনের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে আছে।

চীন যখন অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে ভারতের কাছে এশিয়ান শতক প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন ভারত ছিল ভালো অবস্থানে। তারা চীনা যেকোনো চীনা প্রস্তাবে অনুকূল অবস্থানের জন্য দরকষাকষি করতে পারত। জয়শঙ্করের কৌশলগত ভুলের কারণে ওই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়ে গেছে।

যেকোনো ধরনের সমঝোতা বা সমতাপ্রতিষ্ঠা ভারতের জন্য সর্বোচ্চ অবস্থানের চেয়ে কম কিছু, কিন্তু চীনের জন্য সর্বোচ্চ। ভারত যদি সমতায় যেতে চায়, তবে তাকে চীনে চেয়ে বেশি দিতে হবে, কম পেতে হবে। এখন শর্তাবলী নির্ধারণ করবে চীন, ভারত নয়। আমেরিকার ঝুড়িতে সব ডিম রেখে জয়শঙ্কর কৌশলগত ঝুঁকি নিচ্ছেন না। তিনি জুয়া খেলছেন।

সূত্র : এশিয়া টাইমস

ad

পাঠকের মতামত