327858

আমার বাবা শান্তি কমিটিতে ছিলেন, মুক্তিযু’দ্ধের বি’রুদ্ধে ছিলেন: নাঈমুল ইসলাম খান

নাঈমুল ইসলাম খান: আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দু:খ ও কষ্ট এটি, ৭১ সালে আমার বয়স যখন এগার, সেই ছোট্ট আমিও বুঝতাম, স্বজনদের কথায় শুনতাম, বাবা শ’ত্রু পক্ষে।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ যেদিন কুমিল্লা শহর হানাদার মুক্ত হয়, বিজয়ী মুক্তিযো’দ্ধারা শহরে ঢোকে, সেদিনই আমাদের বাগিচাগাঁওয়ের বাসায় শহরের সুশোভিত সেরা বাগানের মাঝখানটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে বাবার রাজনীতির বি’রুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিদ্রোহ ঘোষণা করি। বাবা নিজেও সেদিন দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে পরাজয় মেনে নেন।

যখন বড় হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তখন আমার সকল চিন্তা-কর্ম, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযু’দ্ধের চেতনায় উদ্বু’দ্ধ।

ঢাকায় ছাত্রাবস্থায়ই জীবনের প্রথম চাকুরি এডবেস্ট নামে বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। এর পরিচালনায় তখন মুক্তিযু’দ্ধের ইতিহাসে খুব উজ্জল ব্যক্তিত্ব, ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী মুক্তিযো’দ্ধারা। বছর ১৯৮০। প্রধান কর্তা পিযুষ বন্দোপধ্যায়কে জানালাম আমার বাবা মুক্তিযু’দ্ধ বিরোধী ছিলেন। তিনি সেদিন অবাক হয়েছিলেন আমি কেন এ কথা বলতে গেলাম। বললেন কাজে মনোযোগ দিতে।

সাংবাদিকতা জীবনে যখন নিজেরাই পত্রিকা করেছি, সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক ভোরের কাগজ তখন আমাদের সকল চেতনা, চিন্তা ও চর্চার কেন্দ্রে ছিলো মুক্তিযু’দ্ধ। আমরা সব সময়ই স্বাধীনতা বিরোধী এবং মানবতা বিরোধী অ’পরাধে অ’ভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ, অবিচল।

মুক্তিযু’দ্ধকালে আমার বাবার যতো অ’পরাধ তারও ত’দন্ত ও বিচার দাবিতে দ্বিধা করিনি। তিনি এখন প্রয়াত, তারপরও মরোণত্তর বি’চার যদি হয় তাতেও আমার সায় আছে।
আমার বাবা মা’রা গেছেন, ৭ মার্চ ১৯৯৮। আমি তার বড় সন্তান। তার জানাযা হয় কুমিল্লা শহরে, দেবিদ্বার উপজেলা সদরে এবং সবশেষে তার জন্মস্থান আব্দুল্লাহপুর গ্রামে। এই তিনটি জানাযায় প্রথামত সমবেত সকলের কাছে বাবার সকল ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছি এবং তার সকল দায়-দেনার দায়িত্ব নিজে গ্রহন করেছি। কিন্তু প্রথার বাইরে গিয়ে প্রতিটি জানাযায় আমি মুক্তিযু’দ্ধের সময় বাবার কোনো কাজে বা কথায় কেউ সামান্য মনোকষ্ট পেয়ে থাকলেও তার জন্য বিশেষ করে ক্ষমা চেয়েছি।

সাংবাদিকতা জীবনে তারপর আমরা করেছি আরও কিছু সংবাদপত্র,দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, ইংরেজি দৈনিক আওয়ার টাইম, দৈনিক আমাদের নতুন সময়, এবং অনলাইন পোর্টাল আমাদের সময়.কম। সবই অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তি যু’দ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ।

একজন মুক্তিযু’দ্ধ বিরোধীর সন্তান হিসেবে আমি সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি রক্তস্নাত মহান মুক্তিযু’দ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এমন একজন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে, যেনো দেশের আরো অনেক মুক্তিযু’দ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীর সন্তানদের জন্য নিজেকে উদহারণ হিসেবে তৈরি করি। মুক্তিযু’দ্ধ বিরোধীর সন্তানরাও মুক্তিযু’দ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হোক এটা আমার প্রত্যাশা।

আজ বিশ্ব বাবা দিবসে আল্লাহতালার কাছে প্রার্থনা আমার বাবার সকল অ’পরাধ ক্ষমা করবেন। আমিন । (এই লেখাটি ২১ জুন ২০২০, বিশ্ব বাবা দিবসে লেখা।) উৎস: আমাদের সময়.কম।

ad

পাঠকের মতামত