312603

টাঙ্গাইলের আসলাম যেভাবে মান্না হলেন

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা মান্না। আজ এই মহাতারকার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৮ সালের আজকের দিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। জগতে কিছু মানুষ থাকেন, মৃত্যুর পর তাঁরা যেন সবার হৃদয়ে আরও বেশি ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকেন। মানুষের মনে চিরকাল অমর হয়েই থাকেন তাঁরা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তেমনই একজন অভিনেতা মান্না।

১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতিতে জন্মগ্রহণ করেন এসএম আসলাম তালুকদার। যিনি বাংলাদেশে মান্না নামেই তুমুল জনপ্রিয়। ছোটবেলা থেকে সিনেমার প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় প্রচুর সিনেমা দেখতেন। নায়ক রাজ্জাকের সিনেমা হলে তো কথাই নেই। সেই রাজ্জাকের হাত ধরেই চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় শুরু তার। টাঙ্গাইলের এসএম আসলাম তালুকদার নামের সেই কিশোর হয়তো তখনও জানতেন না যে তিনিই একদিন হয়ে উঠবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়ক।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ। রাতে শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতেই বুকে উঠল চিনচিন ব্যথা। গৃহ সহকারী মিন্টু পানি এনে খাওয়ালেন মান্নাকে। একটু হাঁটাহাঁটি করে পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে আবার সেই ব্যথা। মিন্টুকে ঘুম থেকে তুলে নায়ক মান্না বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। হাসপাতালে যাব। বুকের ব্যথাটা বাড়ছে।’ নিজেই গাড়ি চালিয়ে উত্তরা থেকে এলেন গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। কিন্তু ফিরলেন প্রাণহীন হয়ে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন এ এস এম আসলাম তালুকদার মান্না। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্রই। বিদায় নিলেন ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক মান্না। আজ এক যুগ পুরলো। তখনকার দিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক মান্নাকে ছাড়া কেটে গেল এক যুগ। মোটেও ভালো কাটেনি। আজও ভালো নেই ঢাকার চলচ্চিত্রভুবন। ভালো নেই এফডিসি, ভালো নেই প্রেক্ষাগৃহ। ভালো নেই মান্নার সহশিল্পীরা। চলচ্চিত্র অঙ্গনে এখন শুধুই হাহাকার। মান্নাশূন্যতা পূরণ হয়নি আজও।

১৯৮৪ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন মান্না। সেখানে পড়াকালীন অংশ নেন নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতায়। তবে খুব সহজ সফলতা পাননি মান্না। এফডিসির অফিস পাড়ায় ঘোরাঘুরি আর নিয়মিত পরিচালকদের কাছে ধরনা দিতে হতো। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু, সেই রাজ্জাকই এক সময় তাকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। ১৯৮৬ সালে ‘নায়করাজ’ রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ‘তওবা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পান মান্না। কিন্তু সে সময় তেমন কোনো সাফল্য আসেনি।

মান্না অভিনীত প্রথম ছবির নাম ‘তওবা’। তার অভিনীত প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত ছবি ‘পাগলি’। ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘কাসেম মালার প্রেম’ ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে কাজ করেন মান্না। ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়াতে মান্নাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দাঙ্গা’ ও ‘ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে তার একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। একে একে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘অন্ধ প্রেম’, মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দেশদ্রোহী’, ছবিগুলো মান্নার অবস্থান শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৯৯ সালে ‘কে আমার বাবা’, ‘আম্মাজান’, ‘লাল বাদশা’র মতো সুপারহিট ছবিতে কাজ করেন মান্না। প্রযোজক হিসেবেও মান্না বেশ সফল ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠান থেকে যতগুলো ছবি প্রযোজনা করেছেন প্রতিটি ছবি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে লুটতরাজ, লাল বাদশা, আব্বাজান, স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ, দুই বধূ এক স্বামী, মনের সাথে যুদ্ধ, মান্না ভাই ও পিতা-মাতার আমানত। মান্নার তার কাজের মাধ্যমে লাখো ভক্তের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

নব্বই দশকের শেষদিকে বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলে প্রথমেই প্রতিবাদ করেন এই মহানায়ক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মান্না একাই লড়ে গেছেন। আশির দশকে সুনেত্রা,রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস, শাহনাজ, নিপা মোনালিসা থেকে শুরু করে চম্পা, দিতি, কবিতার মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনি মৌসুমি, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, অপু, নিপূণ, একার সঙ্গে তার ছবি ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। হাল ধরেছিলেন শিল্পী সমিতির। ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের।

অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তার অভিনীত এমন কিছু ছবি আছে যার জন্য তিনি চিরদিনের জন্য দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। একটা সময় ছিল, যখন ছবিতে শুধু মান্না আছেন- এ কারণেই দর্শক হলে ছুটে গেছেন, তার কারণেই ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর ছবিতেও মান্না ছিলেন অনবদ্য।

ad

পাঠকের মতামত