300127

এক আইসিইউ থেকে অন্য আইসিইউতে টানাটানিতে, ভেস্তে যায় আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন

তুলনার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। একদিন সে আইনজীবী হবে। আইন পড়ে দেশের অন্যায়-অবিচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়বে। মানুষের সেবা করবে।সামনের নভেম্বরের ১৭ তারিখ শুরু হওয়ার কথা ছিল তার পিএসসি পরীক্ষা। ক্লাসের সেকেন্ড গার্ল। চোখে অনেক স্বপ্ন। পিএসসি ভালো করতেই হবে। জীবনের এক অধ্যায় শেষ করে পরের অধ্যায়ে নিজেকে চেনাতে হবে।

কিন্তু তুলনার সব স্বপ্ন স্বপ্নই যেন ভেস্তে গেলো। অকস্মাৎ তার জীবনঘড়ি থেমে গেল। মরণব্যাধি ডেঙ্গু তার স্বপ্নকে বাড়তে দিলো না।তুলনার পুরো নাম তাসকিয়া সরকার। সহপাঠীরা তুলনা বলেই ডাকে। রাজধানীর টিকাটুলিতে অবস্থিত কামরুননেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসের সেকেন্ড ক্যাপ্টেন। বরাবরই সে ক্লাসে ভালো।

তুলনার সহপাঠী নওশিন জাহান জানায়, তুলনা ছিল ক্লাসের হাসিখুশি প্রাণবন্ত শিক্ষার্থী। সারাক্ষণ ক্লাস মাতিয়ে রাখতো হাসি আর আনন্দে। কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার কেঁদে উঠছিল সে। নওশিন আরও জানায়, শনিবার তার জন্মদিন ছিল। কথা ছিল তুলনাকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটবে। হইচই করে ক্লাস মাতাবে সবাই মিলে। এক পাউন্ড ওজনের কেক নিয়ে বন্ধুরা ক্লাসে হাজিরও হয়েছিল। সবার জন্মদিনে সহপাঠীরা এমনটাই করে থাকে। কিন্তু তুলনার ডেঙ্গু জ্বরের খবরে দিনটি সহপাঠীদের কেটেছে উদ্বেগে।

মা ফাতেমা আক্তার জানান, স্বপ্ন ছিল মেয়েকে বড় হলে ‘ল’ পড়াবেন। মেয়ের সাধ পূরণ করবেন। বলতেন, মা তুই বড় ‘হ’। আমি তোকে লইয়ার বানাবার জন্য যা কষ্ট করা দরকার করবো। বাবা মোহাম্মদ স্বপন মিয়া গোপীবাগ বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। গোপীবাগ সপ্তম গলির ৮৯/১ নম্বরে তাদের বাসা।

তুলনার বাবা-মা জানান, ১৯ আগস্ট সোমবার জ্বর এলে রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পরলে প্রথম কদিন বাসায় রেখে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে প্লাটিলেট কমতে থাকলে তাকে নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।

২২ তারিখ বৃহষ্পতিবার হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের বিশ তলার ড্রেসিং রুমের এক্সর্টা ১৭ নম্বর বেডে তুলনাকে রেখে চিকিৎসা চললেও ঠিক তিনদিনের মাথায় ২৪ তারিখ শনিবার সকালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, তার অবস্থা ভালো না। এখান থেকে তাকে বাইরে কোথাও আইসিইউতে নেয়ার জন্য।

কিন্তু হাসপাতালের এক রুম থেকে আরেক রুমে, এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে কাগজপত্র আর আইসিইউতে নেয়ার তদবির করতেই করতেই হয়রান হয়ে পরে তুলনার বাব-মা-স্বজনরা। বিএসএমএমইউর আইসিইউতে একটি সিট খালি আছে তা পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত করে না বললেও বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলতে হবে বলে তুলনার অভিভাবকদের অপেক্ষা করায়।

ওদিকে, ধীরে ধীরে তুলনার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলতে থাকে, বাইরে প্রাইভেটে যেখানে আইসিইউ আছে সেখানে নিয়ে যান। একসময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ ব্যবস্থা না করে ডেঙ্গু সেল থেকে রোগীকে শিশু বিভাগে স্থানান্তর করে।

তুলনার অভিভাবকরা জানায়, বিএসএমএমইউতে থাকা অবস্থাতেই শনিবার সকাল থেকে তার পেট ফুলে যায়। লিভারে জটিলতা দেখা দেয়। তীব্র ব্যথা অনুভব করতে থাকে। ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে তুলনা। ডাক্তারদের বারবার বলার পর এ বিষয়ে কোনও সমাধান না দিয়ে একের পর এক প্রেসক্রিপশন দিয়ে ঔষধ আর স্যালাইন আনায়, এটুকুই। কিন্তু তুলনা ততক্ষণে ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে। দুপুর দুইটার দিকে হাসপাতালের ডেঙ্গু সেল থেকে তাদের জরুরি ভিত্তিতে যেখানে আইসিইউ আছে সেখানে নিয়ে যেতে বলে এবং সাফ বলে দেয় তাদের কিছু করার নেই।

একদিকে মেয়ের কান্না। অন্যদিকে, বাবা-মায়ের উদ্বেগ্ন। কোথায় পাবে আইসিইউ। আশেপাশের বেশ ক’টি হাসপাতালে যোগাযোগের চেষ্টা করে আইসিইউ না পেয়ে তারা বিএসএমএমইউ থেকে বের হয়ে ছুটে যায় উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। সেখানকার ডিউটি ডাক্তাররা রোগীর অবস্থা দেখে আইসিইউতে সিট খালি নেই বলে না করে দেয়। সেখান থেকে তুলনাকে নেয়া হয় বসুন্ধরায় অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানকার জরুরি বিভাগে ডাক্তাররা দেখে আইসিইউতে সিট খালি নেই বলে অন্যত্র যেতে বলে।

অ্যাপেলো থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে তুলনাকে নিয়ে আসা হয় সিদ্বেশ্বরীর ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। সেখানে আইসিইউতে নেয়ার আধঘন্টার মধ্যেই কর্তব্যরত ডাক্তাররা রোগীকে অন্য কোথাও নিতে বলেন। উপায়ন্তর না দেখে কাছাকাছি মগবাজারে রাশমোনো জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে তারা জানায়, তুলনাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। ততক্ষণে জীবন-মৃত্যুর সঙ্কটে তুলনা। পনের মিনিট রাশমোনোতে রাখার পর সেখানেই মৃত্যু ঘটে তুলনার। এক আইসিইউ থেকে আরেক আইসিইউতে নেয়ার টানাটানিতে বাঁচার সকল আশা এভাবেই শেষ হয়ে যায় তুলনার।

শনিবার দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই আট ঘন্টায় তুলনাকে নিয়ে পাঁচবার হাসপাতাল বদল করে তার অবিভাবক।তাদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক চিকিৎসা দেয়া হলে তুলনাকে হয়তো অকালে মরতে হতো না।স্কুলের ক্লাস টিচার, সহকারী শিক্ষক জেবুন নেছা জানান, অসম্ভব মেধাবী ছাত্রী ছিল তুলনা। তার অকালে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তার চলে যাওয়ায় পুরো স্কুলই চিন্তিত।

ad

পাঠকের মতামত