296639

সপরিবারে ঘূর্ণিঝড় দেখতে যাওয়ার বিষয়ে প্রভাষ আমিনের কৈফিয়ত

সপরিবারে ঘূর্ণিঝড় দেখতে যাওয়ার বিষয়ে প্রভাষ আমিনের কৈফিয়ত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করেন প্রভাষ আমিন। পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো-

আমার কৈফিয়ত
প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে আমাকে গালি খেতে হয়। আমি যাই লিখি, তাতেই কিছু লোক দল বেধে গালি দিতে চলে আসেন। গালি তাই আমার গা সয়ে গেছে। তাই গালির ভয়ে থেমেও থাকি না বা কোনো কৈফিয়তও দেই না। তবে গতকাল আমার একটি স্ট্যাটাস নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।

আমাকে গালি না দিলে যাদের পেটের ভাত হজম হয় না, সেই বন্ধুরা তো হজম প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গালি দিচ্ছেনই; আমার কয়েকজন শুভাকাঙ্খীও স্ট্যাটাসটি নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। যারা নিয়ম করে আমাকে গালি দেন, তাদের আমি ভালোবাসি; তারা আমাকে ঠিক বুঝেই গালি দেন। তাদের বোঝানোর চেষ্টাও করি না। কিন্তু কেউ যদি আমাকে ভুল বোঝেন, খারাপ লাগে। ভুল বোঝা শুভাকাঙ্খীদের জন্য আমার এ কৈফিয়ত।

প্রসূনের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নানান ব্যস্ততায় তাকে নিয়ে কোথায় হয়নি। পরে ভাবলাম তার রেজাল্ট এবং রোজা শুরুর আগেই একটা কোথাও যেতে হবে। প্রথমে আমাদের প্ল্যান ছিল শর্টকাটে গাজীপুর বা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল-সিলেটে ঘুরে আসা। কিন্তু প্রসূনের পছন্দ কক্সবাজার। বেড়ানোর উপলক্ষ্য যেহেতু প্রসূন, তাই তার মতটাই প্রাধান্য পেলো। তবে কক্সবাজারে সমস্যা হলো, ব্যাকপেইনের কারণে অামার পক্ষে অত লম্বা পথ গাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। একমাত্র বিকল্প আকাশপথ, তাতে বাজেটের ওপর বড়সর চাপ পড়ে। তারপরও অনেক পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে দিন বিশেক আগে বিমানের টিকেট ও হোটেল বুক করি। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগে ঘূর্ণিঝড় ফণীর উৎপত্তির খবরে আমি শঙ্কিত হই।

ফণীর মোচড়ে যত শক্তি বাড়ে, আমার তলপেটেও তত মোচড়। যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই হতে যাচ্ছিল। আমাদের বেড়ানো আর ফণীর ছোবল হানার দিন প্রায় মিলে যাচ্ছিল। ভয়ে ভয়ে মুক্তির সাথে শেয়ার করি। তার পরামর্শ ছিল, পিছিয়ে দেয়ার। কিন্তু পেছানো সম্ভব ছিল না। আমরা ফিরবো ৫ মে, প্রসূনের রেজাল্ট দেবে ৬ মে আর রোজা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ৭ মে। তাই পেছানোর কোনো চান্স ছিল না। একবার আলোচনা হলো, ট্যুর বাতিল করে দেয়ার। কারণ এত বড় দুর্যোগের সময় নিউজরুমে থাকাটাও জরুরি ছিল। কিন্তু বাতিল করলে পুরো টাকাই গচ্চা যাবে। কারণ পুরোটাই ছিল প্রিপেইড। তাই কোনো উপায় না পেয়ে ঠিক হলো, সাইক্লোনের সাথেই দেখা হোক।

অনেকে ভয় দেখিয়েছেন। আমি বলেছি, কক্সবাজারে লাখ লাখ মানুষ থাকতে পারলে, আমরা পারবো না কেন? তারা যতটা সতর্ক থাকবে, আমরাও ততটুকু। ব্যস। তাই ঝুকিটুকু জেনেই আমরা রওয়ানা দেই। বিমানে ওঠার আগে একটা সেলফি তুলে স্যাটাস দিলাম, ‘সপরিবারে কক্সবাজার যাচ্ছি ঘূর্ণিঝড় দেখতে’। ব্যস তাতেই হাজার হাজার মানুষ তাদের অবদমিত গালির ভান্ডার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যেন আমি ছাড়া আর কেউ কাল বেড়াতে যায়নি।

যেন আমি ছাড়া সবাই সব কাজ ফেলে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ব্যস্ত। অথচ কাল অন্তত ১০টা ফ্লাইট এসেছে কক্সবাজারে। সবগুলো ছিল ভর্তি। এছাড়া বাসে এসেছেন আরো অনেকে। রোজার আগে শেষ শুক্রবারে কক্সবাজার পূর্ণপ্রায়। পূর্ব পরিকল্পিত ছুটি কেউই বাতিল করেননি। যারা আমাকে গালি দিয়েছেন, তারা কি কেউ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পূর্ব নির্ধারিত কোনো অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন?

আমি জীবনে বহু ঝড়, সাইক্লোন, বন্যা দেখেছি; কাভারও করেছি। তাই ঘূর্ণিঝড় দেখতে আমার কক্সবাজার যেতে হয় না। একসময় বাংলাদেশ মানেই ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানোর উপায় নেই। দুর্যোগ এখনও আসে। কিন্তু এখন আর বাংলাদেশ দুর্যোগের কারণে শিরোণাম হয় না, হয় দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষতার জন্য। আমরা দুর্যোগ মোকাবেলায় সবার সেরা। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানী কমিয়ে আনা গেছে। আমরা এখন ঘূর্ণিঝড়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি, একটু হাসি-ঠাট্টা, ফান করাও যেতে পারে। ফণী তো আসবেই। ঠেকাতে যেহেতু পারবো না, তাই সতর্ক অবস্থায় অপেক্ষা করাই ভালো। ভয়ে না কেঁপে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়। ছেলেবেলায় এমন একটা গল্পে পড়েছিলাম, ‘আসুক তুফান, তুফানরে আর ডরাই না’। আমরাও এখন তুফানরে ডরাই না।

আমার এক লাইনের স্ট্যাটাসের কত রকমের যে ব্যাখ্যা। কেন বিমানে যাচ্ছি থেকে শুরু করে আমাদের হাসি, প্রসূনের চুল সবকিছুই তাদের অপছন্দ। এমনকি ‘সপরিবারে ঘূর্ণিঝড় দেখতে কক্সবাজার যাচ্ছি’ এই এক লাইন দিয়ে আমাকে নাস্তিকও প্রমাণ করে ফেলেছেন কেউ কেউ। বেড়াতে আসার সময় ছবি তুললে একটু হাসি হাসি থাকতেই পারে। আর সাংবাদিকরা কোটিপতি না হলেও পথের ফকিরও নয়। পরিবার নিয়ে বছরে একবার কক্সবাজারে আসার সামর্থ্য তাদের আছে।

কক্সবাজার এসেও কিন্তু আমি সার্বক্ষণিকভাবে নিউজরুমে সংযুক্ত। কাল গভীর রাত পর্যন্ত ফোনে আপডেট জানিয়েছি।

অনেকে আমাদের মৃত্যকামনা করেছেন। চেয়েছেন, আমাদের বিমান যেন বিধ্বস্ত হয়, আমরা যেন ডুবে মরি। ফণী যেন আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ তাদের মত পূণ্যবানদের কথা শোনেননি। আল্লাহ মহান, তার দয়ায় আমরা এখনও সহি সালামতেই আছি। যারা আমাদের মৃত্যু চেয়েছিলেন, তাদের জন্য খারাপ লাগছে। তাদের নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়েছে।

আমি জানি সবকিছুই আপেক্ষিক। আমার কাছে যেটা স্বাভাবিক, আপনার কাছে সেটা নাও হতে পারে। আমি সবসময় ভিন্নমতকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ভিন্নমত আর অশ্লীলতা এক নয়। যারা আমি গালি দিয়ে আনন্দ পান, তাদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আমি জানি, নামাজ পড়ার ছবি দিলেও তারা আমাকে গালি দেবেন। তবে আমার বন্ধু-শুভাকাঙ্খী যারা আমার স্ট্যাটাসে ভুল বুজেছেন, কষ্ট পেয়েছেন; তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তাদের কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও সেটা অনিচ্ছাকৃত। যারা দীর্ঘদিন আমাকে চেনেন, আমার সংবেদনশীলতা তাদের অজানা থাকার কথা নয়।

স্ট্যাটাসে আমাকে ডিফেন্ড করতে এসে আমার কয়েকজন বন্ধুও অশ্লীল আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তাদের জন্য ভালোবাসা। যারা আমাকে গালি দেন তাদের জন্যও ভালোবাসা। আমি তাদের মৃত্যুকামনা করি না। আমি চাই, তারা তাদের ভুলটা বুঝতে পারবেন। মানুষকে সম্মান করতে শিখবেন, যুক্তি দিয়ে শালীনতার সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবেন। আল্লাহ তাদের হেদায়েত করুক।

আমি সবসসয় হাসিখুশী থাকি। জীবনের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ইতিবাচক। আমি প্রাণভরে বাঁচতে চাই। অসাধারণ এই মানব জীবন দেয়ায় মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা।

আমার কৈফিয়তপ্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে আমাকে গালি খেতে হয়। আমি যাই লিখি, তাতেই কিছু লোক দল বেধে গালি দিতে চলে আসেন। গালি তাই…

Posted by Probhash Amin on Saturday, 4 May 2019

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলালাইন এবং বাংলালাইন -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

ad

পাঠকের মতামত