289203

অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলার জবানবন্দিতে যা বলেছিলো নুসরাত(ভিডিও)

টানা ১০৮ ঘণ্টা আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে থামতে হলো নুসরাতকে। মৃত্যুর আগে কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক করেন নৃশংস নিপীড়নের শিকার এই শিক্ষার্থী।এ তথ্য জানিয়েছে নুসরাতের চিকিৎসায় গঠিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের মেডিকেল বোর্ড।বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় আইসিইউতেই মারা যান ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি।বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল জানান, মৃত্যুর আগে তিনি লাইফসাপোর্টে ছিলেন।

নুসরাতের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বলেন, নুসরাতকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আমরা।বুধবার সকাল থেকে তার অবস্থা অবনতি হতে থাকে। একাধিকবার তার হার্ট অ্যাটাক হয়, তার পরও সে সার্ভাইভ (বেঁচে ছিল) করেছিল। কিন্তু রাত সাড়ে ৯টার দিকে সব শেষ হয়ে যায়। মারা যান নুসরাত।ঢামেক হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ মেজর বার্ন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ গভীর পোড়া।

তার শ্বাসতন্ত্র পোড়া ছিল। কেরোসিন নিজেই টক্সিক। এটি ফুসফুস ও ব্রেনের কার্যক্ষমতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এসব কারণই তার মৃত্যু হয়েছে বলা যায়।’নুসরাতের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে রাতে ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি- নুসরাতকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না।তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর পর তার মরদেহ ফেনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিপ বার্ন হওয়ায় প্রথম থেকেই রাফির বাঁচার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ।

তিনি বলেন, আগুনে তার শরীর পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। বুধবারও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। সামন্ত লাল সেন জানান, রক্ত ও ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণ থেকে কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেইলিয়র (হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ) হয়। এতেই তার মৃত্যু হয়।তিনি বলেন, ৮০-৮৫ শতাংশ বার্ন হওয়া রোগীর বডিতে অনেক রকম সমস্যা হয়। এই রোগীকে বাঁচানো খুব মুশকিল। বুধবার তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। এ ধরনের পেশেন্টের হঠাৎ মৃত্যু হয়। আমরা সিঙ্গাপুরে কথা বলেছিলাম, তারাও বলেছিল চান্স অব সারভাইবেল কম।নুসরাতের চাচাতো ভাই ওমর ফারুক বলেন, দুপুরে রক্তের দরকার পড়েছিল, তখন আমরা রক্ত সংগ্রহ করে দিই। কিন্তু চিকিৎসকরা সকাল থেকে বারবার রাফির অবস্থার অবনতির কথা বলছিলেন।

চিকিৎসকদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। নুসরাতের মৃত্যুতে জ্ঞান হারান মা। জ্ঞান ফেরার পর ‘রাফিরে, আমার মা রে… মা’ বলে বিলাপ করতে করতে আবারও জ্ঞান হারান।পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হয়। এদিকে রাত সাড়ে ১১টায় নুসরাতের বাবা একেএম মুসা মানিক ও ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানসহ অন্য স্বজনদের গাড়িতে করে একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়।গাড়িতে ওঠার আগে দেশবাসীর কাছে তার মেয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া চান নুসরাতের বাবা। মেয়ে হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

রাতেই খবর পৌঁছায় সোনাগাজীতে। সেখানেও শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামের বাড়িতে তার কাছের আত্মীয়রা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভিড় বাড়তে থাকে নিকট আত্মীয়দের। সবাই জানতে চান কখন মরদেহ পৌঁছাবে, দাফন হবে কখন ইত্যাদি।৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। মাদ্রাসাছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে এমন সংবাদে তিনি ছাদে যান। সেখানে বোরকাপরা ৪-৫ জন তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।

অস্বীকৃতি জানালে তারা রাফির গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় সোমবার রাতে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন অগ্নিদগ্ধ রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।থানায় নুসরাতের জবানবন্দি মোবাইলে ভিডিও করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। ওই ভিডিওতে নুসরাতকে কান্না করতে দেখা যায়। তার মৃত্যুর পর সেই ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিডিওতে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তাকে যেভাবে শ্লীলতাহানি করে তার বিস্তারিত বর্ননা দিয়ে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এ ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়।ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে- কান্নাজড়িত কণ্ঠে নুসরাত পুলিশের কাছে অভিযোগ করছেন। ওই ভিডিওতে নুসরাত জাহান রাফি পুলিশকে জানান, ক্লাসে থাকা অবস্থায় তাকে ডেকে নিয়ে যায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তার এবার আলিম পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।নুসরাত জানায়, তিনি যখন প্রথম বর্ষে ছিলেন তখনই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। অধ্যক্ষ নুসরাতকে বলে ‘তোকে আমার অনেক ভালো লাগে।’

জবাবে নুসরাত বলেন, আমি আপনার ছাত্রী, মেয়ের মতো। এসব কি বলছেন! আমার আব্বুও একজন শিক্ষক। আপনি এসব বইলেন না। আমার খুব খারাপ লাগে।এখানেই শেষ নয়, প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ই অধ্যক্ষ নুসরাতকে ২-৩ তিনবার তার কক্ষে ডেকেছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করে নুসরাত।নুসরাত সে সময় জানান তার মাদ্রাসার বড় হুজুরকে তিনি জানিয়েছে অধ্যক্ষের কথা। কিন্তু হুজুর শুধু তাকে আশ্বস্তই করেন।

অধ্যক্ষ নুসরাতকে বলে, তোর জীবনে তো আগে একটা কলঙ্ক আছে। এখন তোকে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন আমার কাছে থাক।এরপর ওই ভিডিওতে নুসরাতকে বলতে শোনা যায়, আগামীকাল তার শেষ ক্লাস। আর আজ অধ্যক্ষ পিয়ন দিয়ে তাকে ডেকেছে। আর ডেকে তার গায়ে হাত দেওয়া সহ অনেক বাজে কিছু করেছে।যা সে কখনো কল্পনাই করতে পারেন না। নুসরাত জানায় তার দুই বান্ধবীও তার সাথে অধ্যক্ষের রুমে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের যেতে দেওয়া হয়নি। নুসরাত জানায় তার ওই দুই বান্ধবীর নাম নিশাত আর ফুর্তি।এ সময় পুলিশ সদস্যারা নুসরাতকে আশ্বস্ত করেন নুসরাতের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তারা।

ভিডিওটির বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সোনাগাজী থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কামাল বলেন, ওই ভিডিওটি গত ২৭ মার্চের। নুসরাত তার মাকেসহ থানায় এসে অভিযোগ জানাতে এসেছিল। এ সময় নুসরাতের সাথে তার দুই বান্ধবীও ছিল।এদিকে থানায় জবানবন্দি দেওয়ার ওই দিনই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে আছে।

https://www.facebook.com/451259158588786/videos/2584891128404112/?t=2

ad

পাঠকের মতামত