272228

চকবাজার ট্র্যাজেডি : আগুনের সূত্রপাত কেমিক্যাল গুদাম থেকেই

নিউজ ডেস্ক।। সিলিন্ডার থেকে নয়, আগুনের শুরু হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যালের গোডাউন থেকে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এরই মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বিপুল পরিমাণ অতিদাহ্য পদার্থ মজুদ থাকায় ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ঘটেছে। বেড়েছে আগুনের ভয়াবহতা। দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত কমিটি এবং বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত কমিটিও সমকালকে একই তথ্য জানিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) ও তদন্ত কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুন শুরু হয়েছে। তদন্ত কাজ শেষ করেছি। যে কোনো সময় প্রতিবেদন জমা দেব। বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম জানান, তাদের তদন্ত শেষ পর্যায়ে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে- সিলিন্ডার থেকে নয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুন লেগেছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৭১ জন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে ৬৭ জনের। দগ্ধ নয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে চারজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনজন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। দু’জন এখনও চিকিৎসাধীন। ৫২ জনের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পুড়ে কয়লা হওয়া ১৯ জনের লাশ চেনার উপায় নেই। সেগুলো শনাক্তের জন্য আত্মীয়-স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

ঘটনার পর আগুনের উৎসের ব্যাপারে পুরান ঢাকাবাসী একাট্টা হয়ে দাবি করতে থাকেন, সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগেছে। এর কারণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) পক্ষ থেকেও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী নূরুল হুদাকে প্রধান ও কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ছয় সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি। কাজী খায়রুল বাশার সমকালকে বলেন, ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ, এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, পোড়া ভবনের আলামত সংগ্রহসহ আগুনের কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত এবং প্রকৌশল ও কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অগ্নিকাণ্ডের যথাযথ কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে আগুন শুরু হয়েছে। ২ মার্চ আইইবিতে ৫৯তম কনভেনশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। এটি হস্তান্তর করেন আইইবির প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. আব্দুস সবুর।

আইইবির তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি সমকালের হাতে এসেছে। পর্যালোচনাসাপেক্ষে এতে জানানো হয়েছে, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বিপুল পরিমাণ অতিদাহ্য পদার্থ মজুদ করা ছিল। সেখান থেকে আগুন শুরু হয়। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ঘটে দেয়াল ভেঙে ছিটকে পড়ে রাস্তায়। খসে পড়ে ভেতরের দেয়ালের পলেস্তারা। তবে ভেতরের দিকে অক্সিজেন কম থাকায় আগুন সেদিকে বাড়তে পারেনি। আগুন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তার দিকে।

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ : পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের আশপাশে ডিপিডিসির বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল না। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনেও শর্টসার্কিটের আলামত পাওয়া যায়নি। ট্রান্সফরমার যথাস্থানে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনও অক্ষত ছিল। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপভ্যানটি ডিজেলে চলত। ওই ভবনের দোতলায় বাদামের তেল, রেড়ীর তেল, জলপাইয়ের তেল, এয়ার ফ্রেশনার, পারফিউমের গোডাউন। সেখানে প্রসাধনী সামগ্রী মজুদ ছাড়াও খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এসব সামগ্রী উদ্বায়ী ও অতিদাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্লাশ পয়েন্ট ১৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান থেকে প্রোপেলান্ট হিসেবে এলপিজি ব্যবহূত হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা এক ভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ম্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ম্ফোরণ ঘটতে পারে। এলপিজি নিচু ও বদ্ধ স্থানে জমা হয়। জমাটবাঁধা এলপিজি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়াতে পারে এবং স্ম্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্লাশব্যাকের মাধ্যমে বিস্ম্ফোরণ ঘটতে পারে।

আগুন লাগার কারণ : আগুনের তীব্রতা, বিস্ম্ফোরণ ও আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় মজুদ করা দাহ্য পদার্থ। প্রতিবেদনে দাহ্য পদার্থে আগুন লাগার তিনটি সম্ভাব্য সূত্রপাতের কথা জানানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- এক. স্থিতিশীল বিদ্যুৎ থেকে সৃষ্ট স্ম্ফুলিঙ্গ; দুই. বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় সৃষ্ট স্ম্ফুলিঙ্গ; এবং তিন. অসাবধানতাবশত সেখানে কর্মরত ব্যক্তিদের জ্বালানো আগুন।

সুপারিশমালা : আইইবির তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে আটটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আইন ও বিধির অসামঞ্জস্যতা দূর করতে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা প্রয়োজন। এ কমিটি বিভিন্ন সংস্থার সব আইন ও বিধির সমন্বয় করে নতুন একটি সমন্বিত আইন ও বিধি প্রণয়ন করবে। কঠোরভাবে এ আইন প্রয়োগ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের মেয়রকে এ কাজ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া যায়। পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো খুবই সরু এবং বড় যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। তাই এই এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করেছে কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- কেরানীগঞ্জ বা সাভারে কেমিক্যালপল্লী করে পুরান ঢাকার দাহ্য পদার্থের গোডাউন সরানোর ব্যবস্থা করা; গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও পানির লাইনের জন্য আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করা এবং কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও কেমিক্যাল ব্যবহার এবং সংরক্ষণের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের ঝুঁকি সম্পর্কে জানানো। বিস্ম্ফোরক দ্রব্য আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনেরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত