270994

১০ কোটি টাকার জমি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর!

নিউজ েডেস্ক।। নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে তার রয়েছে ১০ কোটি টাকার জমি। চলাফেরা করেন ৩২ লাখ টাকা মূল্যের নোয়া গাড়িতে। দু-দুটি ডকইয়ার্ড আছে তার স্ত্রী ও পুত্রের নামে। অথচ তিনি নিতান্তই এক ‘টোল কালেক্টর’। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের তৃতীয় শ্রেণির এই সেয়ানা কর্মচারীর নাম রফিকুল ইসলাম। বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করেও লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন তিনি। সিবিএর সভাপতি আবুল হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অবৈধ কাজের অভিযোগ। বিআইডব্লিউটিএর হিসাব বিভাগের এই অফিস সহকারী নিজের জামাতার নামে করা লাইসেন্সে রমরমা ঠিকাদারি ব্যবসা করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম করে নিজের ভাইকে সংস্থার কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ উঠেছে, সিবিএর সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেতৃত্বে থাকার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছেন। বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি আদায় ও অধিকার সংরক্ষণের সংগঠন কালেক্টিভ বার্গেনিং এজেন্টের (সিবিএ) বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন ‘বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (শ্রম দপ্তরের নিবন্ধন নং ২১৭৬)’ দুই বছর মেয়াদি বর্তমান কমিটির মেয়াদ আট মাস আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে।

এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগনামাও গেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। বিআইডব্লিউটিএরই কর্মচারীদের এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর ওই দুই কর্মচারীর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অনিয়ম-দুর্নীতির কিছু দালিলিক প্রমাণপত্র সমকালের হাতেও এসেছে।

রফিকুলের যত সম্পদ : বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর সাধারণ সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের টোল কালেক্টর রফিকুল ইসলাম নিজের নামে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার মাজদাইর মৌজায় পাঁচ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমি কিনেছেন। গত বছরের ১৫ নভেম্বর ফতুল্লা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে রেজিস্ট্রি হওয়া দলিলে (নং-১০,৯৪৪) পাকা ভবনসহ জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৮৫ লাখ টাকা। তবে ভবনসহ এ জমির প্রকৃত বাজার মূল্য দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা বলে জানা গেছে। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা মৌজায় পৃথকভাবে ১২, ২৭ ও ৩৭ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। সব মিলিয়ে তার নামে থাকা এসব স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ১০ কোটি টাকা। ব্যবহার করেন ৩২ লাখ টাকা মূল্যের নোয়া গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-২৯১৮)।

রফিকুল ইসলামের স্ত্রী শাহীদা বেগমের নামে রয়েছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ৯৬/১০ এসএস শাহ রোডে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ‘মেসার্স ইব্রাহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নামের একটি ডকইয়ার্ড। একজন সাধারণ গৃহবধূ কী করে এই বিশাল ডকইয়ার্ডের মালিক হলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিআইডব্লিউটিএতে। ডকইয়ার্ডটি স্থাপনের জন্য বিআইডব্লিউটিএ থেকে স্ত্রীর নামে শীতলক্ষ্যা নদী তীরে ২০ কাঠা জমি ইজারাও নিয়েছেন রফিকুল। আরও বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, এই দম্পতির নাবালক ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসাইনের নামেও রয়েছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার গন্ধাকুল এলাকায় আরেকটি ডকইয়ার্ড ‘মেসার্স ইব্রাহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ওয়ার্কশপ’। এটি নির্মাণের জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছে শীতলক্ষ্যা তীরের ছয় হাজার বর্গফুট জমি।

রফিকুল ইসলাম সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে তার মেজ ছেলে ওমর ফারুককে বিআইডব্লিউটিএতে ‘মার্কম্যান’ পদে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানাচ্ছে, সরকারি এই সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা তাদের নিকটাত্মীয়দের নামে নদীর তীরভূমি ইজারা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। রফিকুল স্ত্রী ও ছেলের নামে ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠাসহ শীতলক্ষ্যা নদী তীরের জমি ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে সিবিএর পদ-পদবি ব্যবহার করেছেন। তার দাপটের কাছে অনেকটা অসহায় হয়েই সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

সভাপতিও কম যান না : শুধু সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম নন, সভাপতি আবুল হোসেনও বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর পদ ব্যবহার করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে তার জামাতা (মেয়ের স্বামী) এস এম আরিফের প্রতিষ্ঠান ‘এআর টেল বিডি লিমিটেডের’ নামে করা লাইসেন্সে বিআইডব্লিউটিএতেই রমরমা ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। আরিফ এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যদিও বিধি অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা তাদের নিকটাত্মীয় এ সংস্থার লাভজনক কাজে যুক্ত হতে পারেন না।

সিবিএ সভাপতি প্রভাব খাটিয়ে আপন ছোট ভাই চল্লিশোর্ধ মেহেদী হাসানকে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে বিআইডব্লিউটিএতে ‘মার্কম্যান’ পদে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে মেহেদী হাসানের জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধন করা হয়েছে। যদিও মেহেদীর এসএসসি পাসের সনদে দেখা যায়, তার বয়স চল্লিশের বেশি।

নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যে লাখ লাখ টাকা : আবুল হোসেন ও রফিকুল ইসলামের অবৈধ আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে কর্মচারী নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। গত আড়াই বছরে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়, ড্রেজারসহ বিভিন্ন জলযান, নদীবন্দর ও শাখা কার্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পদে চারশ’র বেশি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে দেড়শ’ নিয়োগ হয়েছে সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের তদবিরে। এ ক্ষেত্রে তারা দু’জন জনপ্রতি পাঁচ লাখ থেকে আট লাখ টাকা করে নিয়েছেন। গত আড়াই বছরে তারা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন পর্যায়ের কমপক্ষে ২০০ কর্মচারীকে বদলি ও বদলিকৃতদের পছন্দের স্থানে পদায়ন করিয়েছেন। এর বিনিময়ে তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবাদ করলেই শাস্তির খÿ : সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এসব অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় সংগঠনেরই কয়েকজন নেতাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন এবং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জীব দাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক তুষার কান্তি বণিক, মুজিবর রহমান এবং মাযহার হোসেন।

অভিযোগনামা ও তদন্ত কমিটি : আবুল হোসেন ও রফিকুল ইসলামের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি লিখিত অভিযোগনামা দিয়েছিলেন বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের মেডিকেল অ্যাটেনডেন্ট মুজিবর রহমান। অভিযোগের পক্ষে দালিলিক প্রমাণপত্রও সংযুক্ত করেন সংস্থার এ কর্মচারী। অভিযোগ পাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌমন্ত্রণালয়। কমিটির প্রধান হিসেবে নৌমন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুছ ছাত্তার শেখকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ কমিটিকে বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অভিযুক্তদের বক্তব্য : প্রধান অভিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে সমকালের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া মেলেনি।

তবে সিবিএর সভাপতি আবুল হোসেন তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, তারাই প্রথম বিআইডব্লিউটিএতে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠিত করে ইউনিয়ন গঠন করেন। তবে তারা সিবিএর ক্ষমতা নেওয়ার পর মাত্র তিন মাস কার্যক্রম চালাতে পেরেছিলেন। এর পর থেকেই নেতৃত্ব হারানো বিএনপি-জামায়াতপন্থি নেতারা এবং নানা অনৈতিক কাজের দায়ে সিবিএ এবং সংস্থা থেকে বহিস্কৃত শ্রমিক-কর্মচারীরা একজোট হয়ে একের পর এক মামলা-মোকদ্দমা ও মিথ্যা অভিযোগ তুলে নানাভাবে তাদের হয়রানি করে আসছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, এ অবস্থায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের সময়টা পেলাম কখন?

তার দাবি, বর্তমান অভিযোগকারী মুজিবর রহমান সংস্থায় একজন বিখ্যাত মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত। নানা অনিয়মের কারণে এর আগে সংস্থা থেকে সাসপেন্ডও হয়েছেন তিনি। এখন বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের সঙ্গে এক হয়ে তিনি মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদের হয়রানি করছেন।

মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়ে আবুল হোসেন বলেন, তদন্ত কমিটিই তদন্ত করে দেখুক আসলে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড হয়েছে কি-না! তাছাড়া আমি ও রফিকুলসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিষয়ে গত দু’বছর ধরেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তদন্ত হচ্ছে। সেখানেও কোনো অভিযোগের সত্যতা দুদক কর্মকর্তারা এখনও পাননি। ভবিষ্যতেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে না, এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, দোষী কি-না সেটা প্রমাণ করা হোক, তারপর যে শাস্তি হয় মাথা পেতে নেব।

জামাতার লাইসেন্সে ঠিকাদারি ব্যবসার কথাও অস্বীকার করেন এই সিবিএ নেতা। তিনি জানান, তিনি ঠিকাদার নন এবং নিজের কাজ ফেলে ঠিকাদারিও করেন না। জামাতা এস এম আরিফ ও তার প্রতিষ্ঠান ‘এআর টেল বিডি লিমিটেড’ সততার সঙ্গে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে আসছে। বিআইডব্লিউটিএর অল্প কিছু কাজের জন্য তারা নিশ্চয়ই মুখিয়ে নেই। তিনি জানান, লাইসেন্স করার পর গত তিন বছরে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ৩০-৪০ লাখ টাকার বেশি ব্যবসা করেছেন বলে মনে হয় না। নিজের ভাই ও চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী মেহেদী হাসানের সংস্থার চাকরিতে যোগদান নিয়ম মেনেই হয়েছে বলেও দাবি করেন আবুল হোসেন। উৎস: সমকাল।

ad

পাঠকের মতামত