235452

ঘরে ঘরে যদি এমন মেয়ে থাকত!

মাহমুদা আকতার: তার সঙ্গে আমার দেখা রাজধানীর এক হাসপাতালে। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত মা ভর্তি আছেন হাসপাতালের এক ওয়ার্ডে, সঙ্গে আছেন মায়াবতী মেয়ে রোজিনা (ছদ্মনাম)। আমি অবাক হয়ে এই শান্ত আর নরম স্বভাবের মেয়েটির সঙ্গে কথা শুনছিলাম। এর আগে আমি কোনো মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবিনি। সত্যি আমাদের জানাশোনার জগৎ কত সীমিত!আপাত দৃষ্টিতে স্বামী, একমাত্র শিশুসন্তান আর শাশুড়িকে নিয়ে রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় সুখের সংসার তার। স্বামী রাজধানীতে নিজের ট্যাক্সি চালায়। আর রোজিনা কাজ করে একটি ওষুধ কোম্পানিতে, ২০ হাজার টাকা বেতনে। সকালে রান্নাবান্না করে খেয়ে দেয়ে অফিসে যায়, দু বছরের শিশুপুত্রকে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে। মাস শেষে স্বামীর হাতে তুলে দেয় ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা থাকে তার কাছে। যদিও তার আসল বেতন সে তার স্বামীকে কখনও জানায় না। কারণ তার মা।

মায়ের দেখভাল আর চিকিৎসা সবকিছু যে তাকেই করতে হয়! একমাত্র বড় ভাই স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র থাকেন। চিকিৎসার খরচ দেয়া তো দূর কি বাত, অসুস্থ মাকে দেখতে আসারও সময় নেই তার। অথচ স্বামীর মৃত্যুর পর এই দুই শিশু সন্তানকে বড় কষ্ট করে মানুষ করেছেন বিধবা মা। তখন হয়ত সমাজের নিয়ম মেনে মাছের বড় পেটিটা আর দুধের পুরু সর ছেলের পাতেই তুলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কর্তৃব্যের বেলায় ছেলের খবর নেই, সব কিছু এখন মেয়ের দায়িত্বে।আর এ নিয়েই তো যত কষ্ট রোজিনার। তার স্বামীর সংসারে মায়ের জায়গা নেই। নিজের বাড়ির কাছে একটি ঘর ভাড়া করে মাকে রেখেছেন। কিন্তু যখন তখন মাকে দেখতে যাবার কোনো সুযোগ নেই তার। লুকিয়ে চুরিয়ে দিনে এক আধবার মায়ের কাছে যায় সে। কিন্তু এ কথা জানাজানি হলেই সংসারে শুরু হয় চরম অশান্তি।

রোজিনার দিন শুরু হয় ভোর চারটায়। সংসারের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ শেষ করে সাড়ে ছয়টার মধ্যেই তৈরি হয়ে নেয় সে। এরপর অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিন্তু সরাসরি অফিসে যাওয়ার বদলে সে যায় মায়ের কাছে। সেখানে মায়ের কিছু কাজ করে তবেই অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা হয় সে। এজন্য প্রতিদিন অফিসে যেতে লেট হয়, ৮টার অফিসে কোনোদিনই ঠিক সময়ে পৌঁছানো হয় না তার। এতেও কোনো কষ্ট ছিল না তার।সমস্যার শুরু মাস তিনেক আগে, যখন মায়ের ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়লো। মায়ের চিকিৎসার জন্য শুরু হলো মহাখালি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ছুটাছুটি। ইতিমধ্যে রাজধানীর এক হাসপাতালে রোজিনার মায়ের অপারেশন হয়েছে। পাশাপাশি চলছে থেরাপি। ইতিমধ্যে মায়ের চিকিৎসা বাবদ ৫০-৫৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি ভর্তি আছেন রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য তার দেশ (নোয়াখালীর রায়গঞ্জ) থেকে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়াকে নিয়ে এসেছে সে।

কিন্তু মায়ের এই অসুস্থতার ও চিকিৎসার কথা জানেন না রোজিনার স্বামী বা শাশুড়ি। প্রতিদিন সকালে নিয়মমত বাড়ি থেকে অফিসের জন্য বের হয় সে। এরপর ছুটে আসে মায়ের কাছে, হাসপাতালে। সারাদিন মায়ের শয্যার পাশে বসে থাকে। কখনও বা ফাইল হাতে চিকিৎসকদের কাছে ছুটোছুটি বা ওষুধ আনতে ছোাটে। এরপর সন্ধ্যা হলে এমনভাবে বাড়ি ফিরে যায় যেন অফিস থেকেই ফিরছে সে। অথচ মায়ের চিকিৎসার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সে।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর একা একা কীভাবে থাকবেন মা, এ নিয়েই রোজিনার যত চিন্তা। ইতিমধ্যে দু হাজার টাকা মাসিক পেতনে এক ঠিকা ঝি জোগাড় করছে যে দুবেলা তার মায়ের রান্না করে দেবে। কিন্তু এমন যদি হত রোজিনার স্বামী আর শাশুড়ি তার মাকে মেনে নিত, একসঙ্গে থাকত সবাই? ‘তাহলে তো কোনো কথাই আছিলো না। আমার সংসারের খরচও অনেক বাইচা যাইত।’

কিন্তু তাতো হবার নয়। তাই রোজিনার আক্ষেপ, আমার যদি বিয়া না হইলে ভালো হইতো, মায়ের এত কষ্ট হইতো না। আমি তো বিয়াই করতে চাই নাই।’এসএসসি পাসের পর ২০০৯ সালে বিয়ে হয়ে যায় রোজিনার। এক প্রকার জোর করেই রোজিনাকে বিয়ে করেছিল তার স্বামী আওয়াল। তখন তার মাকে দেখাশোনা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাস্তব বড় নিষ্ঠুর। তাই বুঝি রোজিনার জীবনে এত কষ্ট, এত ছলচাতুরি।তার পরিশ্রমও তো কম হয় না। এই টানাপোড়েনে নিজের দিকেও নজর দেয়ার সময় নেই তার। ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়েছে সেই কবে, অস্তোপচারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। কিন্তু মাকে এ অবস্থায় রেখে নিজের চিকিৎসার কথা ভাবতে পারেন না মেয়ে। আপাতঃত তাই বন্ধ আছে নিজের চিকিৎসা। এখন আর অন্য কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে চান না রোজিনা।

-যতদিন মা বাইচা আছে তদ্দিন এমনই যাইব। সংসার বা মা কোনোটাই তো ছাড়তে পারমু না।জানি, এই কাহিনী পড়ার পর সবাই রোজিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন। এমন মায়াবত মেয়ে যেন ঘরে ঘরে তাকে, এমন আশাও করবেন অনেকে। কিন্তু রোজিনাদের দুঃখের কারণ নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? যদিও আমরা নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন আর স্বনির্ভরতা নিয়ে বহু বাক্য খরচ করেছি এবং এখনও করছি। কিন্তু রোজিনাদের দেখুন, অর্থ রোজগার করলেও সেই অর্থ নিজের মর্জিমত খরচ করার অধিকার নেই তাদের। বিয়ে করে একজন ক্ষমতাধর স্বামী পেলেও নিজের ঘর নেই তাদের। তাইতো স্বনির্ভর হয়েও দুঃখ ঘোচে না রোজিনাদের!

ad

পাঠকের মতামত