235161

অরিত্রির আত্মহত্যা ও আমাদের কোমায় চলে যাওয়া মানবিকতা

কামরুন নাহার: একবার গায়ে পড়ে এক নকল সমস্যার সমাধান করতে গেলাম। ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। পুরো ফ্লোরে পিনড্রপ সাইলেন্স । আমার সেদিন সকালের দিকে এক্সাম ডিউটি ছিলো। তাই দুপুরটা ফ্রি ছিলাম। ডেস্কে বসে ভালো লাগছিলো না। তাই উঠে একটু হাঁটতে বেরুলাম মানে ওই এক্সাম চলছে তাই অকারণেই এক্সাম হলে ঢুঁ মারার জন্য উঠলাম। দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়েই দেখি ব্যাচের সবচেয়ে চুপচাপ ছেলেটি দাঁড়িয়ে ঘামছে আর কাঁপছে । আমি কাছে গিয়ে বললাম ‘কী ব্যাপার তুমি এক্সাম হলে নেই কেনো এখানে কী করছো’? তখন ও বললো ‘ম্যাডাম, স্যার আমার খাতা রেখে বের করে দিয়েছেন’। আমি কারণ জানতে চাইলাম। ও বললো ‘ম্যাডাম নকল করতে গিয়ে ধরা পড়েছি’। আমি বললাম ‘বলো কী! তা কী নকল করেছো’? ও তখন তার হাত দেখালো – একটা শব্দ ও হাতে লিখেছে। ওটাই স্যার দেখতে পেয়ে খাতা রেখে বের করে দিয়েছেন।

ছাত্রটি তখন বললো ‘ম্যাডাম আপনি একটু স্যারকে বলেন না আর এমন হবে না, আপনি বললে স্যার আমার খাতাটা ফেরত দিয়ে দেবেন’। ও আমাকে যে অনুরোধটুকু করেছিলো সেটা করেছিলো সন্তানের জায়গা থেকে একজন মায়ের কাছে, একজন শিক্ষকের কাছে নয়। কারণ শিক্ষক যিনি ছিলেন তিনিও এই বিভাগ থেকে পাশ করে সদ্য প্রভাষক হিসেবে যোগদান করা আমাদেরই ছাত্র। তাই আমিও আশাবাদী ছিলাম আমি অনুরোধ করলে হয়তো উনি এই ছাত্রটিকে পরীক্ষা দিতে দেবেন। কিন্তু আমার অনুরোধে কাজ হয়নি স্যার ছেলেটিকে আর এক্সাম দিতে দেননি। অন্য কোনো সিনিয়র শিক্ষক হলে আমি এই অনুরোধটি করতাম না। কারণ একজন সিনিয়র আমার চেয়ে ভালো জানেন কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে।

নীতিগতভাবে স্যার স্যারের জায়গায় ঠিক ছিলেন। সদ্য কাজে যোগদান করা টগবগে যুবক তিনি; নীতি-নৈতিকতা আর নিয়ম কানুনের চূড়ান্ত শিখরে তার অবস্থান তখন। তাই উনি ওনার জায়গায় শতভাগ ঠিক ছিলেন; অঠিক বা বেঠিক আসলে আমিই ছিলাম। কারণ নকল করা যেমন অন্যায় একজন নকল করা ছাত্রের জন্য সুপারিশ করতে যাওয়াও অন্যায় যেটা আমি করেছিলাম। নকল করা অন্যায় আর অন্যায়ের শাস্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই শাস্তি ছাত্রটি পেয়েছে। তবে একটা কথা এতো বড় শাস্তি শিক্ষার্থীটির পাওনা ছিলো না।

এবার নীতির জায়গা থেকে একটু মানবিকতার জায়গায় আসি, নিয়মের ঘেরাটোপ থেকে একটু বের হই। পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যা আছে যেগুলো কোনো কমিটি বা সিন্ডিকেট ছাড়াই আন্তরিকতা, মানবিকতা আর নিষ্ঠা দিয়ে সমাধান সম্ভব । হ্যাঁ সমস্যার ধরনটা বা অন্যায়ের ধরনটা একটা জরুরী বিষয় বটে। যদি নকলের বিষয়টিই ধরি তাহলে একজন কোন লেভেলের নকল করেছে বা এক্সাম কতদূর হয়েছে সেগুলো একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নকলের ধরনগুলো এমন হয় যে তা নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটানোর দরকার হয় না বা এক্সাম কমিটি পর্যন্ত দৌড়াতে হয়না। একটু মানবিকতার আর বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে দেখলে নিজে নিজেই তার সমাধান সম্ভব। আঙ্গুলে একটি শব্দ লিখে নিয়ে আসা বা পুরো একটা প্রশ্নের উত্তর লিখে নিয়ে আসার মধ্যে পার্থক্য আছে কিন্তু অন্যায় দুটোই। শাস্তি একজন দুটোর জন্যই প্রাপ্য। এখন কথা হলো শাস্তিটা কেমন হবে, কোন ভাষায় হবে। শাস্তি দেবার সময় আমরা যারা শিক্ষক তাদের মাথায় রাখতে হবে লঘু পাপে আমরা যাতে কাউকে গুরুদণ্ড দিয়ে না দেই। এখন লঘু পাপ কী আর গুরুদণ্ড কী তার একটা মানদণ্ড আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে। অরিত্রি কিন্তু লঘুপাপে গুরুদণ্ডের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে।

অরিত্রি যেটা করেছে সেটা অপরাধ অবশ্যই। কিন্তু আমার কথা হলো এর চেয়ে বড় অপরাধ স্কুল কর্তৃপক্ষ করে বসে আছে। একজন শিক্ষার্থী মোবাইল নিয়ে এক্সাম হলে ঢোকার অনুমতি পায় কিভাবে? একমাত্র ক্যালকুলেটর ছাড়া অন্য কোনো ডিভাইস নিয়ে এক্সাম হলে ঢোকা নিষেধ অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই; এই স্কুল কেনো নিষিদ্ধ করলোনা!! এবার আসি অরিত্রির অপরাধে। ও ছবি তুলে নিয়ে এসেছে। অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু মিলিয়ে দেখা উচিত ছিলো মোবাইলের উত্তরের সাথে খাতার উত্তরের মিল আছে কীনা! যদি না থাকে তাকে শাসিয়ে এক্সামের অনুমতি দিয়ে দেয়া যেতো। আমি নিশ্চিত সে এই কাজটা আর করতো না। যদি উত্তরের মিল পাওয়া যেতো তাহলে চাইলেই তাকে আধাঘণ্টা পরীক্ষা দেয়া থেকে বিরত রাখা যেতো। আর মিল পাওয়া উত্তরটি কেটে দিলেই হতো। যদি তাও না হতো তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ যেটা করেছে সেটাই তারা করতে পারতেন একটু ভিন্নভাবে, একটু সহনশীলতার সাথে, একটু ভালো ভাষায়, একটু মানবিকভাবে। অরিত্রির সামনে তার মাবাবার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করাই ঠিক হয়নি। আর সেটা করলেও সেটা আরও ভালোভাবে হতে পারতো।

অরিত্রির যে বয়স তা খুবই সেনসিটিভ বয়স। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আত্মসম্মান বোধ, অভিমানের মাত্রা, ঘৃণার মাত্রা, ভালোবাসার মাত্রা সবই হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের । এতো এতো মেধাবী (!) শিক্ষকগণ কেনো এই সাধারণ বিষয়টা বোঝেন না!! এই বয়সের ছেলেমেয়েদের সবকিছু হ্যান্ডেল করতে হয় সবচেয়ে বেশি যত্ন আর সংবেদনশীলতা দিয়ে। অরিত্রির মা বাবার সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো সমস্যা আছে কীনা সেটা তারাই বলতে পারবেন।

গতকাল এক টিভি টক শোতে মনোবিজ্ঞানী ডক্টর মেহতাব খানম বলছিলেন আমাদের অধিকাংশ স্কুলে আলাদা করে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা নেই। স্কুলের শিক্ষকরাই কাউন্সেলিং দেন কিন্তু কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমারও ব্যাক্তিগত মত থাকা উচিত। তো এতো দামী একটা স্কুলের কাউন্সেলিং এর অবস্থা যদি এই হয় তাহলে বাকীদের কী অবস্থা। স্কুল আর কলেজের শিক্ষকরা কোচিং বানিজ্যে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীকে কাউন্সেলিং দিতে গেলে তাদের মোটা টাকা লস হয়ে যাবে!! তথাকথিত এই স্কুলটির কোচিং বানিজ্য বেশ রমরমা । কোচিং না করলে নাকি পরীক্ষায় ভালো নাম্বারও দেয়না! সন্তানদের দেবার মতো সময় আমাদের ব্যস্ত মা বাবাদের নেই। ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তির ক্ষেত্রে ডোনেশন দেবার জন্য মা বাবারা যতো যত্নের সাথে লিঙ্ক খুঁজে বের করেন, লবিং করেন ততোটা যত্নশীল যদি তারা সন্তানদের লেখাপড়ায় এবং তাদের অন্যান্য বিষয়ে হতেন তাহলে অরিত্রিরা আত্মহত্যা করতোনা।

অরিত্রির আত্মহত্যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কী ভয়াবহ অরাজকতা, অব্যাবস্থাপনা আর দুর্নীতির শিকার! আর এখনকার দিনে শিক্ষা বাণিজ্য সবচেয়ে বড় বাণিজ্য । অনেক টাকাওয়ালারা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেন; নিয়োগ হয় টাকা, আত্মীয়তা আর রাজনৈতিক দাপটের ভিত্তিতে। মন্ত্রী নেতার সুপারিশে, বাবা সচিব সেই সুবাদে যাকে তাকে শিক্ষক করে বসিয়ে দেবেন তাহলেতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলবেনা! টিচিং ইজ নট এভরি ওয়ানস কাপ অফ টি। ভালো লেকচার দেয়ার বাইরেও একজন শিক্ষকের আরও বেশ কিছু গুণ থাকা দরকার; মানবিকতা, পরিমিতিবোধ, সেন্স অব প্রপোরশন এবং ডেডিকেশন এর মধ্যে অন্যতম।

এইসব তথাকথিত ভালো স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করার জন্য যে সকল মাবাবা মোটা অঙ্কের ডোনেশন নিয়ে বসে আছেন সেই তাদেরকে আমি সম্মানের সাথে ধিক্কার জানাই। স্যালুট জানাই আমার সেই বান্ধবীকে যে তার মেয়ের এই স্কুলে চান্স হয়নি বলে নিজেও মন খারাপ করেনি; মেয়েকেও মন খারাপ করতে না দিয়ে তার বর্তমান স্কুল যে কোনো অংশেই কম নয় সেটা বুঝিয়েছে।শিক্ষকদের বলছি আপনারাও মা-বাবা কিন্তু অরিত্রির মা-বাবার জায়গায় নিজেদের বসাতে পারেননি; মা-বাবাদের বলছি আপনারা সন্তানের বেস্ট ফ্রেন্ড হোন আর ছাত্রছাত্রীদের বলছি ‘নকলকে না বলো’।লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট

ad

পাঠকের মতামত