
আক্রান্ত জাফর ইকবাল: তিন মাস আগে ছুরি ক্রয়, সাইকেলে রেকি
ডেস্ক রিপোর্ট।।
দেড় মাস আগেই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হামলা করে হত্যার চূড়ান্ত ছক কষে ফয়জুর রহমান ওরফে ফয়জুল ওরফে ফয়জুল হাসান। তবে ২০১৬ সাল থেকে সে জঙ্গি ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়। আর মাসতিনেক আগে সিলেটের ‘আল হামরা’ মার্কেট থেকে ছুরি কিনেছিল সে। এ ছাড়া জাফর ইকবালকে হত্যা করতে আনসার আল- ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি) নীরবে হত্যার কৌশল সংক্রান্ত পোস্ট অনলাইনে পড়ে শাবি ক্যাম্পাস রেকি করতেই একটি সাইকেল কিনেছিল ফয়জুর। এরই মধ্যে বেনামে ফেসবুকে তার চারটি আইডি পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
চমকপ্রদ তথ্য হলো, আনসার আল-ইসলামের নামেই একটি আইডি চালাত সে। তার আরেকটি ফেসবুক আইডির নাম আবু মোসাব। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত ফয়জুরের ব্যবহূত চারটি মোবাইল নম্বর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এদিকে ফয়জুরের একটি মোবাইল ও ট্যাব নিয়ে এখনও পলাতক আছে তার ভাই এনামুল। ধারণা করা হচ্ছে, এনামুলও উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাকে গ্রেফতার করা গেলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সূত্রে গতকাল বুধবার এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিটিসির ডিসি মুহিবুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, ঘটনার দিন ক্যাম্পাসের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে দেখা হয়েছে। ফয়জুর আগেই ক্যাম্পাস রেকি করেছিল এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত অনলাইনে ফয়জুরের উগ্রবাদ চর্চার কিছু তথ্যও মিলেছে। তবে কোনো জঙ্গি সংগঠন তাকে অনলাইনে দাওয়াত দিয়েছে কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও সে দাবি করেছে, একাই সে ওই হামলায় জড়িত ছিল।
পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, হামলার দিন ক্যাম্পাসের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, লাল গেঞ্জি-পরিহিত অবস্থায় একটি লাল সাইকেল নিয়ে সকাল ৯টা ৫১ মিনিটে শাবি ক্যাম্পাসে যায় ফয়জুর। ১১টা ২২ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসে সে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ক্যাম্পাস এলাকা রেকি করে সে। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত হামলার সময় বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আবার ক্যাম্পাসে যায় ফয়জুর। ওই সময় তার পরনে ছিল কালো টি-শার্ট। বিকেল ৪টা ৪২ মিনিটের দিকে মুক্তমঞ্চে ওঠে সে। সেখানেই ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আয়োজনে ‘ইইই ফেস্টিভ্যাল’ চলছিল। আর হামলার ঘটনা ঘটে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। সকালে ক্যাম্পাস এলাকা রেকি করার সময়ই ফয়জুর নিশ্চিত হয়, ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা কালো টি-শার্ট পরবে। তাই নিজের পরিচয় লুকাতে বিকেলে হামলার সময় কালো টি-শার্ট পরে আসে সে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অনলাইনে জঙ্গিদের যেসব গ্রুপ রয়েছে, সেখানে জাফর ইকবালকে ‘নাস্তিক’ ও ‘ইসলামের শত্রু’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেসব গ্রুপ নিয়মিত দেখত সে।
ফয়জুর এরই মধ্যে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে, জাফর ইকবালের ওপর হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করার পর শরীর ও টার্গেট ঠিক রাখতে নিয়মিত জিমে যাওয়া শুরু করে। এর আগে কখনও চূড়ান্ত হামলার প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্পাসে যায়নি ফয়জুর। তবে রেকি করতে বিভিন্ন সময় গিয়েছিল। কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্নিষ্ট থাকার ব্যাপারে বারবার জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করে সে।
এ ছাড়া যে কম্পিউটারের দোকানে ফয়জুর কাজ করত, সেখানকার কর্মচারী সুমনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঘটনার পর থেকে পলাতক আছে সুমন। পুলিশ বলছে, ফয়জুরের ভাই এনামুল ও সুমনকে গ্রেফতার করা গেলে হামলার ঘটনার আরও তথ্য মিলতে পারে। আনসার আল-ইসলামের জঙ্গিরা সাধারণত তাদের টার্গেট করা ব্যক্তিকে হত্যা করতে ছুরি-চাপাতির মতো ‘ক্লোড আর্মস’ ব্যবহার করে থাকে। কীভাবে নীরবে হত্যা করা হয়, এ সংক্রান্ত বইও আছে তাদের। ফয়জুর অনলাইনে এসব বই পড়ে আসছিল।
এদিকে ফয়জুরের মা-বাবা পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ঘটনার পরপরই ভয়ে তারা পালিয়ে গেছেন। ফয়জুর এত বড় হামলার পরিকল্পনা করছে, এটা তারা বুঝতে পারেননি। তবে ফয়জুর নিজে লা-মাজহাবি (মাজহাববিরোধী বলে পরিচিত)। প্রবাসী দুই চাচাকে অনুসরণ করে সে সালাফি মতাদর্শে বিশ্বাসী- এটা জানতেন তার মা-বাবা।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে কেউ ফয়জুরকে তথ্য দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে সহায়তা করেছিল কি-না তা বের করার চেষ্টা চলছে। তবে ঘটনার সময় ফয়জুরের পাশে দাঁড়ানো অপরিচিত এক ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে অনেকে যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারণা করেছিল, তার পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি হলেন পুলিশের রিকুইজিশন গাড়ির চালক। তাকে ঘিরে এখন আর কোনো সংশয় নেই। ক্যাম্পাসে অপরিচিত হওয়ায় তাকে ঘিরে চলছিল নানা সন্দেহ ও অবিশ্বাস। উৎস: সমকাল