নয়া ফর্মুলায় ‘বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ ভিজিটিং কার্ড’ দিয়ে অবৈধ বাণিজ্য
সকাল ৯টা। ফার্মগেট ওভারব্রিজ। ওভারব্রিজের ফার্মভিউ সুপার মার্কেট পাশে দাঁড়িয়ে ৭ থেকে ৮ বছরের এক শিশু। পথচারীদের হাতে সে ধরিয়ে দিচ্ছে একটি ভিজিটিং কার্ড। কার্ডে বড় হরফে লেখা এক বাপ্পী ভাইয়ের নাম ও মোবাইল নম্বর। এর নিচে নির্দোষ ভঙ্গিতে উল্লেখ করা হয়েছে একটি আবাসিক হোটেলের নাম।
এরপর লেখা, ‘বিস্তারিত জানতে মোবাইলে যোগাযোগ করুন।’ এর পরের তথ্য, আমাদের এখানে এসি, নন এসি রুম ভাড়া দেয়া হয়।’ এরপর উল্লেখ করা হয়েছে হোটেলের লোকেশন।
সকাল ১১টা। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণি গলি পথ। বোরকা পরিহিত এক নারী আবাসিক এ এলাকাটিতে চলাচলকারী পথচারীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন একটি কার্ড। এ কার্ডেও বড় হরফে লেখা এক ব্যক্তির নাম ও দু’টি মোবাইল নম্বর। কার্ড ধরিয়ে দেয়া নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি দ্রুত সটকে পড়েন।
পরে কার্ডে উল্লিখিত রানা ভাই নামের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয় ফোনে। ফোন করতেই হোটেলের যাবতীয় সুবিধার কথা গড় গড় করে বলে দেয়া হয় (রেকর্ড সংরক্ষিত আছে)। পরিষ্কার হয়, অবৈধ যৌন ব্যবসা রমরমা করতেই শহরে আগ্রাসী ভঙ্গিতে ছড়ানো হচ্ছে ওইসব ভিজিটিং কার্ডের প্রচারপত্র। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কেবল রাজধানী ফার্মগেট বা মিরপুর এলাকাতেই নয়, ঢাকার অন্যান্য এলাকাতেও একাধিক চক্র একই কায়দায় অবৈধ ব্যবসা প্রসারে বিলি করছে ভিজিটিং কার্ড।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় এক হাজারের মতো আবাসিক হোটেল আছে। এসব হোটেলের একটি অংশে প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই চলে অবৈধ ব্যবসা। হোটেল মালিকেরা দিন হিসাবে প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেন। শুধু প্রশাসন নয়, এলাকার প্রভাবশালী অনেকেও সাপ্তাহিক, মাসিক ভিত্তিতে এসব হোটেল থেকে তোলে বিপুল পরিমাণ চাঁদা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পর্বতা সেনপাড়ার এক ব্যক্তি জানান, মিরপুর এলাকায় গত কয়েক মাস ধরে আবাসিক হোটেলে অবৈধ ব্যবসা বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি হোটেল মালিকরা মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে নতুন করে ওই ধরনের অবৈধ ব্যবসা শুরু করেছে। আর মানুষকে জানান দিতে শুরু করেছে আগ্রাসী প্রচারণা। হতাশ কণ্ঠে ওই ব্যক্তি আরো বলেন, লেখালেখি করে তেমন লাভ হয় না। মিডিয়ায় লেখালেখি হলে মাঝে মধ্যে পুলিশ দু-একটি অভিযান চালায়। কিছু নারী-পুরুষ আটক হয়। উচ্ছেদ অভিযান বলতে যা বোঝায় আসলে তা করা হয় না।
সরজমিনে মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যেসব আবাসিক হোটেলে অবৈধ ব্যবসা জমজমাট সেসব হোটেলের বাইরে নেই কোনো সাইনবোর্ড। কিছুদিন অবৈধ ব্যবসা বন্ধ থাকার পর নতুন করে নির্বিঘ্নে ব্যবসা শুরু করার শর্ত হিসাবেই সংশ্লিষ্টদের প্রশাসনের তরফে সাইনবোর্ড ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয়া হয়। এ শর্ত মেনেই মিরপুর এলাকায় বিশেষ করে কাফরুল থানা এলাকার হোটেলগুলোতে সম্প্রতি শুরু হয়েছে অবৈধ ব্যবসা।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন হোটেল মালিক জানান, স্থাপনার দেয়াল ও প্রবেশ পথ থেকে সাইনবোর্ড তুলে দেয়ায় হোটেলগুলো এক ধরনের পরিচয় সংকটে পড়েছে। সংকট মোকাবিলায় একটি দালাল চক্র নিজ নিজ নামে তৈরি করে নিয়েছে ‘অমুক ভাই, তমুক ভাই’ জাতীয় ভিজিটিং কার্ড। আর তারা নিজেদের নেটওয়ার্ক বাড়াতে বিভিন্ন জনবহুল এলাকার পাশাপাশি আবাসিক এলাকাতেও ছড়াতে শুরু করেছে বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ ভিজিটিং কার্ড। যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
এসব বিষয় নিয়ে মিরপুর মডেল থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, অভিযুক্ত হোটেলগুলো মিরপুর মডেল থানাধীন নয়। যোগাযোগ করা হলে কাফরুল থানার ওসি (তদন্ত) মো. আসলাম উদ্দিন মঙ্গলবার মানবজমিনকে বলেন, আবাসিক হোটেলের নামে ভিজিটিং কার্ড বিলি করে অবৈধ ব্যবসা চালানো হচ্ছে- এ ধরনের ঘটনা আমি আগে শুনি নাই। এই প্রথম শুনলাম। এরপর তিনি অভিযুক্ত একাধিক হোটেলের নাম ও ঠিকানা নেন এবং বলেন, আমি আজই ব্যবস্থা নিচ্ছি, ফোর্স পাঠাচ্ছি।
বুধবার সকালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কাফরুল থানার ওসির (তদন্ত) নির্দেশে এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এতে ৯ নারীসহ আটক হয়েছেন ২২ জন। বুধবারই আটককৃতদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। উৎস: মানবজমিন।