আমাগো শরীর ছুঁতে মানা নেই, লাশ ছুঁতে মানা
এপারে রেল লাইন। রেল লাইন ঘেঁষে দৌলতদিয়া বাজারের যে চিত্র, তা কিন্তু যৌনপল্লীর পূবপাড়ে চোখে পড়বে না। যৌনপল্লী যেন একেবারে মিশে গেছে গ্রাম-বাংলার রূপে রূপে। পাড়ার খানিক দূরেই পদ্মা পাড়। স্থির চিত্তে কান পাতলে পদ্মার গর্জনও শোনা যায় যৌনপল্লী থেকে। পাখপাখালির শব্দ, নির্মল বাতাসেরা তো ঘিরেই রাখে ‘নরক’ নামের এ যৌনপল্লীকে। আর পল্লী ঘেঁষেই যৌনকর্মীদের জন্য কবরস্থান, যেটিকে ওরা এখন স্বর্গ জানে।
পল্লীকে নরক-ই জানে ওরা (যৌনকর্মীরা)। যে নরক থেকে মরেও রক্ষা নেই। স্বপ্নসাধে জন্ম নিলেও পল্লীতে এসে সে স্বপ্নেরা ফিকে হতে থাকে। পুরুষের মনোরঞ্জনে শরীরের পসরা মেলে ধরলেও ওরা মনপালক কখনই মেলে ধরতে পারে না। না ওড়া মনের পালক খসে খসে পড়ে বলে ওদের জীবনপ্রদীপ নিভে যায় যৌনপল্লীর অন্ধকার গলিতেই।
তবে মরেও ওরা ফিরতে পারে না স্বদেশে। অন্ধকার চোরাপথে আলোর দেখা মেলে না জীবনের শেষ বেলাতেও। তাই প্রাণহীন চোখেও স্বজনের মুখ দেখতে মানা ওদের। বেঁচে থাকাতেই যে শরীর ‘অভিশপ্ত’, মৃত্যুর পর সেই শরীর নিয়ে আরও বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এ পাড়ার নারীদের। যৌনকর্মীর জীবন্ত শরীরের গন্ধ শুঁকে যে পুরুষেরা মাতোয়ারা থাকেন দিনের পর দিন, সে পুরুষেরাও ওদের লাশ দাফনে শরিক হন না, লাশ ছোঁয় না।
আগে অধিকাংশ লাশই পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়া হত। গ্রামের কোনো মৌলভীও জানাজা পড়াতে আসেন না এ পাড়ায়। কোনো ডোমও আসেন না হিন্দু নারীদের লাশ সৎকারে। পল্লী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনের কর্মীরাই লাশের জানাজা আর দাফনের ব্যবস্থা করেন।
এ পল্লীর কোনো যৌনকর্মীর মৃত্যু ঘটলে বিড়ম্বনার অন্ত থাকে না। এখানকার নারীদের বেশির ভাগই পাচার হয়ে আসা। আর যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আসেন, তারাও নিজের নাম, পরিচয় গোপন রাখেন। এমনকি অনেকেই ধর্ম পরিচয়ও গোপন রাখেন। এসব কারণে চাইলেও লাশ নিজ ঠিকানায় পাঠানো যায় না। আর্থিক সমস্যা তো রয়েছেই।
আবার চাইলেই যৌনপল্লীর আশপাশের গ্রামের কোনো কবরেও দাফন করা যায় না এখানে মৃত্যুবরণ করা নারীদের লাশ। ধর্মীয় আর সামাজিক বাধার কারণেই যৌনকর্মীর লাশ দাফনে নানা বাধা। লাশ দাফন নিয়ে যৌনকর্মীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর মারামারিও হয়েছে একাধিকবার।
আগে অধিকাংশ লাশই পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়া হত। গ্রামের কোনো মৌলভীও জানাজা পড়াতে আসেন না এ পাড়ায়। কোনো ডোমও আসেন না হিন্দু নারীদের লাশ সৎকারে। পল্লী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনের কর্মীরাই লাশের জানাজা আর দাফনের ব্যবস্থা করেন।
এখন অবশ্য যৌনকর্মীর লাশ দাফনের কিছুটা সুরাহা হয়েছে। ২০০৬ সালে তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ পল্লীর পাশেই হোসেন মণ্ডল পাড়ায় কবরস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যৌনকর্মীদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থান ইট দিয়ে ঘিরেও দিয়েছেন সাবেক সাংসদ আলী নওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম। এখন অনেকটা স্বস্তিতেই দাফন হয় এখানকার অভাগা নারীদের লাশ। যদিও বাইরের লোকেরা জানা যায় শরিক হন না। খদ্দের আর পল্লীতে বসবাসরত পুরুষরাই এখানকার জানাযা নামাজের মুসল্লি।
কথা হয়, পল্লীর পুরাতন যৌনকর্মী নাসিমার সঙ্গে। বলেন, ‘বেঁচে থাকতেই যে জীবন অভিশপ্ত, সে জীবন মৃত্যুর পর সুখ পাবে কেন? আমাদের কাছে পুরুষরা আসেন শরীরের গন্ধ নিতে। নাশের গন্ধ নেবে কেন? আমাগো শরীর ছুঁতে মানা নেই, লাশ ছুঁতে মানা।’
আরেক যৌনকর্মী নীলা বলেন, ‘আগে যখন পল্লী গোয়ালন্দ বাজারের কাছে ছিল, তখন কারও মৃত্যু হলে সবাইকে বিপদে পড়তে হত। দুদিনেও লাশের বিহিত হত না কখনও কখনও। পাড়ায় লাশ থাকলে খদ্দের আসতে চাইত না।
এ যৌনকর্মী বলেন, ‘অনেক সময় লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত। কবরস্থান নিয়ে আন্দোলন করেছি আমরা। প্রশাসনের কাছে গিয়েছি। অবশেষে সাংসদ আলী নওয়াজ আমাদের কবরস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন ওই কবরস্থানই আমাদের কাছে স্বর্গ, আর এ পল্লী নরকই রইল।