ফুটপাথে প্রতিরাতে চলে ইজ্জতরক্ষার লড়াই
নিশুতি রাতে নিঃশব্দে গাড়িটা কখন এসে দাঁড়িয়েছিল, তা টের পাননি ওঁরা। মুনিরার চিৎকারে ঘুম ভাঙে কয়েক হাত দূরে শুয়ে থাকা রশিদা বানুর। দেখেন, দুজন মিলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মুনিরাকে। চিৎকার করে একাই এগিয়ে গিয়েছিলেন রশিদা। কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও সেই রাতের স্মৃতি এখনও ভোলেননি কলকাতার গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নিচের বাসিন্দা রশিদা বানু।
ওই ফ্লাইওভারের নিচের আর এক বাসিন্দা বাপি পালের মুখ থেকে শোনা যায় বাকি ঘটনা। মুনিরাকে বাঁচাতে এগিয়ে যেতেই দুষ্কৃতকারীরা রশিদার ওপর ক্ষুর চালিয়ে পালায়। হাতে আজও সেই ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছেই একটি ইলেকট্রনিক্স বিপণির কাচের জানালায় দাঁড়িয়ে টিভির পর্দায় ব্রেবোর্ন রোডের কিশোরীর ঘটনা জেনেছেন এই অঞ্চলের ফ্লাইওভারের নিচে বসবাসকারীরা।
কিন্তু এমন ঘটনা অবাক করেনি তাঁদের। রশিদা মণ্ডল, বাপি পাল, ছোটু ঘোষ, রশিদা বানুরা জানালেন, রাস্তার গাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে শুরু করে তাঁদের হৃৎস্পন্দন। কখনও মদ্যপের চিৎকার, কখনও পার্টিফেরত যুবকদের কটূক্তি, কখনও নিশাচর নেকড়েদের লোলুপ দৃষ্টি- প্রতিদিন, প্রতিরাতেই সহ্য করতে হয় তাঁদের। গভীর রাতে মাঝেমাঝেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে ‘ভদ্রলোকরা’ গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে তাঁদের।
সতর্কতা আর একতাই সম্বল রাস্তায় সংসার পেতে বসা এই মানুষগুলোর। তাই সবাই চেষ্টা করেন কাছাকাছি থাকতে। গভীর রাতে অপরিচিত কাউকে সন্দেহজনক ভাবে আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই সবাই মিলে তেড়ে যান। আইনরক্ষক? নাঃ, আইন তাঁদের রক্ষা করার জন্য নয় বলে জানালেন এখানকার ফুটপাতে জন্মানো ছোটু ঘোষ। বললেন, ‘পুলিশ সতর্ক হলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারি। এর বেশি কিছু বলব না।’
আমাদের এখানেই তো থাকতে হবে, ওঁদের দয়ায়। ‘শহরের অন্য প্রান্তে মৌলালিতে যাঁদের রাত কাটে ফুটপাথে শুয়ে, তাঁদের অভিজ্ঞতাও আলাদা কিছু নয়। এখানকার শাহজাহান মণ্ডল, আমিনা বিবি, রোশনরা জানালেন, মাঝরাতের শিকারীদের থাবা থেকে ছোটদের রক্ষা করাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ দিনই রাতের দিকে পুলিশি টহলদারি দেখা যায় না। আমিনা জানালেন, ‘দিনের বেলাতেই অনেক সময়ই দেখি কিছু লোক খুব খারাপ নজরে দেখছে আমাদের মেয়েদের দিকে।’
রাতের দিকে ওই মুখগুলোকে মাঝেমাঝেই ফিরতে দেখেন তাঁরা। বোঝেন, মুহূর্তের অসতর্কতায় সব শেষ হতে পারে। তাই রাত গভীর হতেই সতর্কতার মাত্রা বাড়ে ফুটপাথবাসী নারীদের। শুধুই পার্টিফেরতদের লালসাময় হাত নয়, অন্ধকারের সুযোগ নিতে ছাড়ে না ট্যাক্সিচালকদের একাংশও। মাঝেমাঝে তাই ফুটপাথবাসীদের দঙ্গলের কাছে নিঃসাড়ে থামে ট্যাক্সির চাকা। কঠিন পরিস্থিতি ওঁদের প্রতিদিন শিখিয়েছে কাউকে না বিশ্বাস করতে। খিদে জয় করার চেয়েও তাই ইজ্জতরক্ষার লড়াইকেই গুরুত্ব দেন কলকাতার পথবাসীরা।