180134

আব্বু, কাইনদো না, পুলিশ আংকেলের কাছে আছি আমি

সকাল সাড়ে নয়টা। ব্যস্ত ঢাকা শহর কর্মব্যস্ত লোকজনের কোলাহলে মুখরিত। গাড়ির হর্ণ, লেগুনার ধোয়া, রিক্সার টুংটাং, পায়ে হাঁটা মানুষের ঘামে ভেজা শরীর জুড়ে গন্তব্যে পৌঁছার ব্যস্ততার ছাপ। কারো দিকে কারো তাকানোরও সুযোগ নেই।
শ্যামলী ওভার ব্রীজের পিলার ঘেঁষে দাড়িয়ে কাঁদছিল একটি শিশু।বাচ্চাটিকে এভাবে একা কাঁদতে দেখে মোহামমদপুর থানার বাইক প্যাট্রল ডিউটিতে নিয়োজিত এসআই রাজিব মিয়া মোটর সাইকেল থামিয়ে বাচ্চাটির পাশে দাড়ায়।

‘বাবু, কাঁদছো কেন? নাম কি তোমার?’-জিজ্ঞেস করতেই বাচচাটি নিজের নাম ‘সজীব’ জানিয়ে আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-‘আমি বাড়ি যাবো। আব্বু-আম্মুর কাছে যাবো’। বাবু, তোমার বাড়ি কোথায়? নাম কি তোমার আব্বু-আম্মুর?’-জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চাটি জানায় ‘তার আব্বুর নাম মজনু। বাড়ি দুববা’। তুমি ঢাকায় কিভাবে এলে? তার আব্বু এখন কোথায় সে
জানে না। সজীব আরো জোরে কাঁদতে লাগলো।

এসআই রাজিব তাৎক্ষণিকভাবে বাচচাটির কথা জানিয়ে দিল পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যাতে সজীব নামের বাচ্চাটির হারানো সংবাদ তার পরিচিত লোকজন জানতে পারে। পাশের হোটেলে বাচচাটিকে নাসতা করিয়ে মোটর সাইকেলে বাচচাটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাচ্চাটির পরিচিত লোকজনের সন্ধানের। শ্যামলী, রিং রোড, আসাদ গেট, তাজমহল রোড, টাউন হল, নূরজাহান রোড, কল্যাণপুর, গাবতলী, মিরপুর, আগারগাও, মানিক মিয়া এভিনিও, ফার্মগেট এলাকা খোজা হলো তন্ন-তন্ন করে। খুঁজে পাওয়া গেল না তার পরিচিত কাউকে।

জানতে চাওয়া হলো তার চাচা, মামা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-বোনের নাম। কারো নাম বলতে পারলো না সে। বাড়ির কথা বারবার জিজ্ঞেস করাতে সে শুধু বলতে পারলো, ‘ইককুল’ ও ‘আদদান’এই দুটো শব্দ। বারবার আব্বু-আম্মু ও বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করার এক পর্যায়ে সে বলতে থাকলো, ‘আব্বু মমনচিং,

পুলিশের ধারনা হলো, বাচচাটির বাড়ি ময়মনসিংহ হতে পারে। ময়মনসিংহের সব থানায় ফোন করা হলো। জানতে চাওয়া হলো ‘সজীব, বয়স: ৫-৬ বছর, পিতা: মজনু’ এই ব্যাপারে কোন নিখোজ জিডি বা অভিযোগ আছে কি না।

ময়মনসিংহের সব থানা থেকে ‘না-সূচক’ উত্তর পেয়ে এসআই রাজিব ময়মনসিংহের সব থানায় মোবাইল ফোনে জানতে চায় ঐ থানায় দুববা নামে কোন গ্রাম আছে কিনা

সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিউনিটি পুলিশ ও লোকজনের সাথে কথা বলে। দুই ঘন্টার মধ্যে ময়মনসিংহের সব থানা থেকে না-সূচক উত্তর পায় এসআই রাজিব।এরপর শেরপুর জেলা পুলিশের সাথে কথা বলে। সেখান থেকেও না-সূচক উত্তর পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে এসআই রাজিব।

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নেত্রকোনা জেলা পুলিশের সাথে কথা বলে এসআই রাজিব। নেত্রকোনার সব থানা থেকে না-সূচক উত্তর আসে।

মিনিট পর এসআই রাজিবের মোবাইলে নেত্রকোনার কলমাকানদা থানা থেকে লোকমান নামে একজন ফোন করে জানায় যে, কলমাকানদা থানার ডিউটি অফিসার তাকে এসআই রাজিবের সাথে কথা বলতে বলেছে। কলমাকানদা থানায় দুববা নয় তবে ‘দূর্গা’ নামে একটি গ্রাম আছে।

এসআই রাজিব ঐ লোককে অনুরোধ করে দূর্গা গ্রামের কোন অধিবাসীর মোবাইল নম্বর দেওয়ার জন্য। ১০ মিনিট পর দূর্গা গ্রামের অধিবাসী সেলিম মিয়া এসআই রাজিবকে ফোন করে। এসআই রাজিব তার কাছে জানতে চায় দূর্গা গ্রামে মজনু মিয়া নামের কেউ আছে কি না।

-হ্যা আছে। সোলেমানের পোলা মজনু।ইস্কুলের উত্তর দিকের দোচালা ঘরটা তার।
কি করে মজনু?-আগে এলাকায় দোকানদারী করতো। এখন ময়মনসিংহে কাঁচামালের ব্যবসা করে
মুহুর্তের মধ্যে এসআই রাজিবের মাথায় সজীবের মুখে বার বার উচ্চারিত হতে থাকা ‘ইককুল’ ‘মমনচিং’ শব্দ দুটোর অর্থ স্পষ্ট হয়। সে সেলিম মিয়াকে দূর্গা গ্রামের মজনুর সজীব নামে কোন ছেলে আছে কিনা জানানোর জন্য অনুরোধ করে। কিছুক্ষন পর সেলিম তাকে জানায় যে, মজনুর ছেলের নাম সে জানে না । তবে মজনুর বড় ভাই সুজনের ছেলের নাম আদনান।

সজীবের মুখে উচ্চারিত ‘আদদান’ শব্দটি স্পষ্ট হয় এসআই রাজিবের কাছে। সেলিমের মাধ্যমে মজনুর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে এসআই রাজিব তার কাছে জানতে চায় মজনুর সজীব নামে কোন ছেলে আছে কিনা।
জবাবে মজনু জানায় তার বড় ছেলের নাম সজীব। বয়স সাত বছর।বয়সের তুলনায় তার বুদ্ধি কম ও উচ্চারণে সমস্যা থাকায় তাকে ঢাকার মিরপুরে একটি আবাসিক মাদ্রাসায় দেওয়া হয়েছে

এসআই রাজিব টেলিফোনে সজীবের সাথে তার আব্বু মজনু মিয়ার কথা বলিয়ে দেয়। পিতা-পুত্র পরষ্পরকে চিনতে পারে। মজনু চিৎকার করে কাঁদতে থাকলে সজীব বলতে থাকে, ‘আব্বু, কাইনদো না। পুলিশ আংকেলের কাছে আছি আমি’।
মোহামমদপুর থানায় এসে হারানো মানিক সজীবকে নিয়ে যায় তার আব্বু-আম্মু। মিরপুরের সেই মাদ্রাসা থেকে পথ ভুলে অথবা কোন খারাপ লোকের খপপরে পড়ে শ্যামলী এলাকায় চলে এসেছিল সজীব।

ad

পাঠকের মতামত