180017

ইনু যেমন সত্য বলেছেন কাদের তেমনি মিথ্যা বলেননি

তথ্যমন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু যেমন সত্য বলেছেন জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও মিথ্যা বলেননি। গণতন্ত্রের নবযাত্রায় একক ভোটযুদ্ধের ময়দানে সেই ১৯৯১ ও ৯৬ সালে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। ৯৬ সালেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জাসদ রবের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ক্যারিশমা ও প্রজ্ঞায় দীর্ঘ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজপথের বিজয়ের সড়কে উঠে ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হলেও তাদের সমর্থন নিয়ে তার সরকারকে ঐক্যমতের সরকার বলেছিলেন। সংসদ ও রাজনীতি আর গণতন্ত্র যতোটা মানুষ পেয়েছিল, যতোটা আকর্ষণবোধ করেছিল সেই দুই শাসনমলেই ভোগ করেছিল। কারাবন্দি থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ দুই নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনেই জয়ী হননি তার পার্টি ৩৫টি করে আসল দখল করে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আর্বিভূতই হয়নি রংপুরকে তার রাজনীতির দূর্গ গড়েছিলেন।

সেনাশাসন যুগের অবসানের পর দীর্ঘ ২৭ বছর দেশের রাজনীতিতে অনেক উত্থান পতন ঘটেছে। অনেক ভাঙাগড়ার খেলা হয়েছে। বুড়িগঙ্গায় জল কতোটা গড়িয়েছে তার চেয়েও প্রশ্ন এসেছে কতোটা বন্ধা ও দূষিত হয়েছে। তেমনি রাজনীতিও কতোটা বন্ধাত্বের মুখোমুখি আর কতোটা দূষিত হয়েছে সেই প্রশ্নও এসেছে। এসেছে প্রতিহিংসা দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতির বদলে রাজদুর্নীতির হাওয়া। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে তেমনি তার বিরুদ্ধে এ্যাকশনও হয়েছে। রাজনৈতিক হত্যা, ক্রসফায়ার, গুমের ঘটনাও ঘটেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক স্রোত দুটি স্রোতধারায় বইতে দেখা গেছে। ৯৬ সালের নির্বাচনে ১১৬টি আসন নিয়ে পরাজিত বিএনপি কাজী জাফর আহমদের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগ বিরোধী বিভক্ত সকল ভোটকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চারদলীয় জোট গঠন করে।

২০০১ সালের নির্বাচনে ব্যাপক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করলেও আওয়ামী লীগকে ৫৭টি আসন ধরিয়ে দিয়ে বিএনপি জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, দমন, নির্যাতন, দুর্নীতি, হাওয়া ভবন কেলেংকারী, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিবাদের উত্থানের মুখে সরকারবিরোধী জনমত যখন প্রবল হয়ে উঠছিল তখন একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্যোগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে ১৪ দল গঠন হয়েছিল।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেটি মহাজোটে রুপান্তরিত হয়েছিল। বিএনপির অবহেলা, অত্যাচারের মুখে পতিত সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা ও কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি সেই মহাজোটের শরীক হয়। সেই সময় কর্নেল অলির সভায় ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওপর বিএনপির হামলা ছিলো নজিরবিহীন। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে চারদলীয় জোটে নিতে বিএনপির পক্ষে তারেক রহমান অনেক বৈঠক করেন কিন্তু শেষ মুহুর্তে এরশাদ আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে যখন পল্টনে ১৪ দলের মঞ্চে উঠলেন তখন পল্টন জুড়ে তুমুল করতালি ও উল্লাস। সেই সময় ১৪ দল গঠনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল শেখ হাসিনার প্রতিনিধি হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আর অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু। গণতন্ত্রী পার্টির নুরুল ইসলাম, যিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে রহস্যজনকভাবেই আগুনে পুড়ে পুত্রসহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এবং তৎকালীন গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মরহুম সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস ও জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়ার ভূমিকাও ছিলো উল্লেখ করার মতো। আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, মরহুম আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ গোটা আওয়ামী লীগ সেই ঐক্যে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ভোটযুদ্ধ করে যেমন ক্ষমতায় আসতে পারেনি তেমনি হাসানুল হক ইনুও ভোটের ময়দানে বারবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েও সংসদে আসতে পারেননি। সেই ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই হাসানুল হক ইনু মাঠে ময়দানে একদিকে সাম্প্রদায়িকতা ও দলবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন অন্যদিকে আওয়ামী লীগের একলা চলো নীতি পরিহারের আহবান জানাতে থাকেন। সেই সময়টা ১৪ দলের জন্য এমনকি মহাজোটের জন্য আওয়ামী লীগের জন্য তো বটেই এক কঠিন সময় ছিলো। রাজপথে বিএনপির পুলিশ বা কোহিনুর মার্কা ক্যাডাররা রাজপথের নারী কর্মীদেরই নির্যাতন করেনি আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতাদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে। সেই দিনগুলোতে ১৪ দল গঠন বা মহাজোটের প্লাটফর্মে ছোট দলের নেতারা থাকলেও তাদের সম্মিলিত শক্তি বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিল। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন জনমত জরিপে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকলে বিএনপি জোট তাদের প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীনের অধীনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর পথই গ্রহণ করেনি এক কোটি ২০ লাখ জাল ভোটারের ভুতুড়ে ভোটার তালিকায় তৈরি করেনি একতরফা নির্বাচনেও ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল।

আজকের হাসানুল হক ইনুর প্রতি বিএনপির রাগ, ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। জামায়াত পারলে তাকে চিবিয়ে খায়, এটাও সত্যি। খালেদা জিয়াকে আওয়ামী লীগ নেতাদের চেয়েও তিনিই বেশি আক্রমণ করে থাকেন। কিন্তু তার নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ তার শান্তি মাঝেমধ্যেই কেড়ে নেয়। সেখানে হাসানুল হক ইনু যে বক্তৃতা করেছেন তা কোন অসত্য প্রলাপ বকেননি। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের কাছে ৮০ পয়সা থাকলে আমাদের সবাইকে সাথে নিলে এক টাকা হয়ে যায়। এক টাকা হলে ভোটে জিতে আসা যায়। জনসমর্থনের ব্যাখায় বা জোটশক্তির রাজনৈতিক মিত্রশক্তির হিসেবের খাতায় তিনি ভুল বলেননি। আওয়ামী লীগ এককভাবে ভোটযুদ্ধে গেলে ফতুর হয়ে যে ফিরবে না তার গ্যারান্টি নেই।

হিসেবের খাতা শেখ হাসিনার কাছে থাকলেও মাঠে ময়দানের আওয়ামী লীগ দলীয় কিছু সংখ্যক দাম্ভিক, উন্মাসিক নেতাকর্মীরা এরশাদের জাতীয় পার্টি, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ও ইনুর জাসদকে দু আনা মূল্য নিতে নারাজ। সেই বেদনাবোধ থেকে ইনু যেমন সত্যচিত্র তুলে ধরেছেন তেমনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও মিথ্যা বলেননি। তিনিও বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাসদ ভোটযুদ্ধে গেল ফলাফল কি হবে ইনু তা জানেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বশীল নেতার মতোই বলেছেন, সবার দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি, দলীয় জোট ও সরকারি ফোরামে আলোচনা করে সমাধান করবো। আওয়ামী লীগের নৌকার পালে জোয়ার আনতে হলে এরশাদের জাতীয় পার্টি, ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি সম্মান ও মর্যাদা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে; এটাই সত্য।

সূত্র: পূর্ব পশ্চিম

ad

পাঠকের মতামত