যেখানে বিমান গেলে আর ফিরে আসে না!
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যআজো এক চির অমীমাংসিত রহস্য। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই বিশেষ ভৌগলিক ত্রিভুজক্ষেত্রটি অতিক্রম করার সময় নাকি অধিকাংশ জাহাজ, বিমান রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। ফ্লোরিডার মেলবোর্ন থেকে বারমুডা দ্বীপপুঞ্জ হয়ে পুয়ার্টো রিকা এবং সেখান থেকে আবারো মেলবোর্ন পর্যন্ত কাল্পনিক রেখা টানলেই পাওয়া যায় অসংখ্য রহস্যের জন্ম দেয়া অভিশপ্ত ত্রিভুজ, যা আয়তনে প্রায় ৪৪০০০০ বর্গ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
.
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যকে আরও ঘোলাটে করে তোলে, এমন বেশকিছু বিষয় আছে। তারই একটি এমন যে, এখানে যত জাহাজডুবি বা বিমান নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোর একটিরও নাকি ধ্বংসাবশেষ বা যাত্রীদের মৃতদেহ পরবর্তীতে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৭৪ থেকে ‘৭৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পাঁচ শতাধিক জাহাজ এবং বিমান নিখোঁজ হয়। তার একটা বড় শতাংশই হারিয়েছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মাঝেই। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করলেই জাহাজ, বিমান প্রভৃতি এমন হুট করে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার পেছনের প্রকৃত কারণ আজো অজানাই রয়ে গেল।
তবে এ রহস্যের কিনারা করতে একেবারে হাত গুটিয়ে বসেও কিন্তু নেই। নানা সময়ে নানাজন, নানা কারণ উল্লেখ করে চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের সমাধান করার বিষয়টি ওঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নরওয়ের গবেষকরা উত্তর মেরুর ব্যারেন্টস সাগরের তলদেশে বেশকিছু বড় গর্তের সন্ধান পেয়েছেন। আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, এই গর্ত বা আগ্নেয়গিরির মুখগুলোর ব্যাস ৩ হাজার ২৮০ ফুট ও গভীরতা ১৩১ ফুট হতে পারে। থ্রিডি সিসমিক ইমেজিং পদ্ধতিতে এই গর্তগুলো শনাক্ত করেছেন তারা। গবেষকরা বলছেন, তেলের খনি থেকে সৃষ্ট উচ্চচাপের মিথেন গ্যাসের উদগীরণে এ গর্ত সৃষ্টি হতে পারে।
ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই আবিষ্কারের ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামের বিতর্কিত ওই এলাকায় জাহাজ ও বিমানের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারে। এর আগে ২০১৪ সালে সাইবেরিয়ান টাইমসকে দেয়া রাশিয়ার গবেষক ভ্লাদিমির পোতাপভের এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়েছে ডেইলি মেইল।
পোতাপভের তত্ত্ব অনুযায়ী, মিথেন গ্যাসের উদগীরণ সমুদ্রকে উত্তপ্ত করে। মিথেনযুক্ত পানির কারণে জাহাজ ডুবে যায়। এ ছাড়া বায়ুমণ্ডলেও বিশেষ পরিবর্তনের ফলে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ক্যারিবীয় সাগরের এক কল্পিত ত্রিভুজ এলাকা হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। ত্রিভুজের তিন বিন্দুতে আছে ফ্লোরিডা, বারমুডা আর প্যুয়ের্তো রিকো।
অবশ্য এই বিন্দু নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তবে সে যা-ই হোক, এ অঞ্চলটিকে মারাত্মক রহস্যময় এলাকায় পরিণত করেছে কিছু খবর। বলা হয়, এ ত্রিভুজ অঞ্চলে অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে মানুষ, জাহাজ আর উড়োজাহাজ। রেখে যায়নি কোনো ধ্বংসাবশেষ। এসব খবর নিয়ে গবেষণা হয়েছে, ডকুমেন্টারি বানানো হয়েছে। শেষমেশ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সব রহস্যের অসারতা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু রহস্যপ্রিয় মানুষ এতে বিশেষ খুশি হতে পারেননি। তারা এখনো বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় চরিত্র প্রথম নিয়ে আসেন ই ভি ডব্লিউ জোনস। ১৯৫০ সালের বার্তা সংস্থা এপি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জোনস অভিযোগ করেন, এ এলাকায় বেশকিছু উড়োজাহাজ ও নৌযান বেমালুম উধাও হয়ে গেছে, যেগুলোর কোনো সন্ধান আজ পর্যন্ত মেলেনি।
দুই বছর পর ফেট ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে দাবি করা হয়, ১৯৪৫ সালে ফ্লাইট-১৯ নামের মার্কিন নৌবাহিনীর পাঁচটি বোমারু বিমানের একটি বহর উধাও হয়ে গেছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। এই বহর থেকে শেষ বার্তা ছিল, ‘সবকিছুই খুব অদ্ভুত লাগছে। আমরা জানি না, কোন দিক পশ্চিম।
এরপর একের পর এক খবর গত শতকের শেষ পর্যন্ত তুমুল হইচই তুলেছে। যার মধ্যে আস্ত ডিসি বিমান, যাত্রীবাহী জাহাজ পর্যন্ত উধাও হয়ে যাওয়ার খবর ছিল। তবে এসব খবরের পাশাপাশি ব্যাখ্যাও চলেছে। বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, এর সবই স্বাভাবিক ঘটনা। ঠিক রং চড়িয়ে বলা হচ্ছে।
আবার বলা হয়েছে, দুনিয়াজুড়ে দুর্ঘটনার যে হার, এতে বারমুডায় মোটেও বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে না। কখনো কখনো বারমুডা-সংক্রান্ত খবর তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, খবরটাই ভুয়া। রং চড়িয়ে লেখা হয়েছে ট্যাবলয়েডগুলোতে।
অনেকের মতে, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কাছ থেকে সর্বপ্রথম এলাকাটির বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। কলম্বাস লিখেছিলেন, তার জাহাজের নাবিকরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি এবং আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এ ছাড়া তিনি কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশের কথাও বর্ণনা করেছেন।
অনেকে আবার মনে করেন, নাবিকরা যে আলো দেখেছেন তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন এবং কম্পাসে সমস্যা হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। ১৯৫০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) সাংবাদিক ই ভি ডব্লিউ জোনস সর্বপ্রথম এলাকাটি নিয়ে খবরের কাগজে লেখেন।
অনেকে মনে করেন, ওই অন্তর্ধানের কারণ নিছক দুর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। তাছাড়া এই ত্রিভুজের ওপর দিয়ে মেক্সিকো উপসাগর থেকে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত বয়ে গেছে। এর তীব্র গতি অধিকাংশ অন্তর্ধানের কারণ। আবার কেউ কেউ বলেন, যারা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন তারা একবার সেখান থেকে ঘুরে আসলেই পারতেন- কি আছে সেখানে। অজানা রহস্যটা তাদের মুখ থেকেই জানা যেত। তথ্যসূত্র : ডিসকভারি, দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল।