যেসব শাস্তি পেতে যাচ্ছেন মিয়ানমার সেনাপ্রধান
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অপরিমিত মতা প্রয়োগের প্রতিবাদে মিয়ানমারের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ মর্মে এক চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইইউ সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি রাখাইন পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এ চুক্তিটি ইইউর রাষ্ট্রদূতরা অনুমোদন করেছেন এবং সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে তা স্বারিত হবে। এতে বলা হয়েছে, এত মানুষের পালিয়ে যাওয়া ‘সংখ্যালঘুদের উৎখাতের বিষয়টিকেই ইঙ্গিত দেয়’।
উভয় পকে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে চুক্তিটিতে বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তাবাহিনীর অপরিমিত শক্তি প্রয়োগের ঘটনায় ইইউ এবং এর সদস্য দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সবধরনের আমন্ত্রণ বাতিল করছে এবং সবধরনের প্রতিরা সহযোগিতা পুনর্বিবেচনা করা হবে।’ মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানিতে আগে থেকেই ইইউর নিষেধাজ্ঞা ছিল। প্রস্তাবিত চুক্তিতে বলা হয়েছে, যদি সঙ্কটের উন্নতি না ঘটে তাহলে আরো পদেেপর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
নিষেধাজ্ঞার ফল ভালো হবে না : মিয়ানমার
এ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞায় ভালো কিছু হবে না বলে হুমকি দিয়েছে মিয়ানমার। দেশটির শীর্ষ সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমসকে দেশটির মতাসীন ডি-ফ্যাক্টো সরকারের শীর্ষ বেসামরিক প্রতিনিধিরা বলেছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব না পড়লেও পরিবর্তন আসবে আর্থ-সামাজিক প্রোপটে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের সঙ্কট। ব্যাহত হবে শান্তি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিভিন্ন পদপে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। ওই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিকরা জানান, সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, বৌদ্ধনেতাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা রয়েছে আলোচনার টেবিলে।
দেশটির পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী উ তুন তুন নাইং বলেন, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা শোনা যাচ্ছে। এটা ভালো খবর নয়। অর্থনৈতিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারা আমাদের অন্য দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাধা দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, আমরা সব দেশের সাথেই বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাই। যখন কেউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায়, আমাদের রাখাইন নিয়ে সত্য বলতেই হয়। এ নিষেধাজ্ঞা আমরা চাই না। আমরা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরব।’
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয় : সেনাপ্রধানের দাবি
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হাইয়াং বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েলের সাথে এক বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এসব কথা বলেন। এরপর বৈঠকের সেই আলোচনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের পেজে পোস্ট দেন মিন। তবে সেনাসদস্যদের দ্বারা রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে ওই বৈঠকে তিনি কোনো কথা বলেননি বলে জানা গেছে।
এমনকি মিন অং হাইয়াং রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, তারা মিয়ানমারের জন্য তিকর। আর সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনই এ জন্য দায়ী। এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সেনাপ্রধান মিন অং হাইয়াং বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি দাবি করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালি’ ইস্যু। আর এ সত্য প্রতিষ্ঠায় একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান বলেন, ‘তারা কোনোভাবেই মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। নথিপত্র প্রমাণ করে, তারা কখনো রোহিঙ্গা নামেও পরিচিত ছিল না। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই তারা বাঙালি ছিল। মিয়ানমার তাদের এ দেশে নিয়ে আসেনি। ঔপনিবেশিক আমলেই তারা এসেছিল।’
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতর বুধবার বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে ঘরবাড়ি, শস্য ও গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ৬৫ জন রোহিঙ্গার সাাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা এক রিপোর্টে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতর বলেছে, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশ ফাঁড়িতে বিদ্রোহীদের হামলার আগে থেকেই সেখানে রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন ও শিশুদের ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটানো হয়।
এতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চলতি সপ্তাহে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস নেই সু চির
সিনহুয়া
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সহিংসতা কবলিত রাখাইন রাজ্যে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী হামলার শিকার’ হওয়া মানুষের পুনর্বাসনের পদপে দ্রুত করতে তাগাদা দিয়েছেন। তবে সেখানে সংঘটিত জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ও রাখাইনের রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
গত বুধবার নেইপিদোতে দেশটির জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় সু চি রাখাইনের ‘সন্ত্রাসী হামলার শিকার’ হওয়া এলাকাগুলোতে মানবিক ত্রাণ পৌঁছানো, পুনর্বাসন ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যকর ও দ্রুত পদপে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সন্ত্রাস আরসার সৃষ্টি করা বলে দাবি করে মিয়ানমারের সরকার। সেই সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির অবস্থানও অভিন্ন।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির অবস্থান মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে একটুও আলাদা নয়। রাখাইন পরিস্থিতিকে রোহিঙ্গা নিপীড়ন নয়, জাতিগত সঙ্ঘাত আখ্যা দিয়ে আসছেন তিনি। রাখাইন পরিস্থিতির নেপথ্যে আরাকান আর্মির সন্ত্রাসকেই বড় করে দেখেছেন। সু চি তার ১৯ সেপ্টেম্বরের বক্তব্যে ৩০টি পুলিশ চেকপোস্ট আর একটি রেজিমেন্টাল হেড কোয়ার্টারে সন্ত্রাসী হামলার জন্য রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি এবং এর সমর্থকদের দায়ী করে আইনের আওতায় নেয়ার হুমকি দেন। সেই বক্তব্যের সমালোচনায় অ্যামনেস্টি বলেছিল, বালুতে মুখ গুঁজে আছেন তিনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার বিরুদ্ধে এনেছিল সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন আড়ালের অভিযোগ।
সূত্র: নয়া দিগন্ত