176339

ব্লু হোয়েলের মৃত্যুফাঁদ রক্ষার ১৩ উপায়

‘আর কোনো প্রেম আমার চাই না। আমার মৌনতা ভাঙার চেষ্টা তাই কোরো না; আমাকে বোঝাতেও এসো না।

আমি নিজেই তো নিজেকে বুঝি না। যা কিছু বলি, যা কিছু দেখি—জগতে তার সবটা বলার উপায়ও নেই। আর আমি কী চাই—নিজেও কি জানি! কেউ নিঃসঙ্গ হতে চায় না। কিন্তু আমার আর কিছুর দরকার নেই—সেইখানে যাওয়া ছাড়া; সেইখানে। কেবল তার পরই আমি নিজেকে বুঝতে পারব। এই হচ্ছে আমার চাওয়া, আর কিছু না, কিছু না, কিচ্ছু না। ’ করুণ গলায় গানটি বাজছে, সঙ্গের ভিডিও চিত্র বিষণ্নতায় মোড়া। লোকালয় ছেড়ে একটি মেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশে। দূরে শূন্যতায় ঘাই মারছে বিশাল এক নীল তিমি। এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। শেষ দিকে দেখা যায়, গাড়ির দরজা খোলা। আরোহীর এবার লক্ষ্য দূরের অতল জল। গানটি যখন শেষ হয়—মেয়েটি কোথাও নেই। আর ছটফটানো তিমিটি এখন নিথর। তখনো গান বাজছে—‘আমার আর কিছুর দরকার নেই—সেইখানে যাওয়া ছাড়া; সেইখানে…। ’

বিশ্বজুড়ে কুখ্যাত এক ‘গেম’ এ ধরনের বিষাদের গান শুনিয়েই এক শ্রেণির শিশু-কিশোরকে চরম জীবনবিমুখ ও মৃত্যুকামী করে তুলছে; পাশাপাশি ভৌতিক চলচ্চিত্র দেখিয়ে, ধারালো ছুরির আঘাতে আঘাতে দেহ-মনকে একটু একটু করে ব্যথা সহনীয় করে শেষ মুহূর্তে তাদের বলছে, ‘যাও এইবার তুমি জীবন থেকে ঝাঁপ দাও, শূন্যে লাফিয়ে পড়ো। ’

সাগরের ‘ব্লু হোয়েল’ বা ‘নীল তিমি’ স্বভাবে উপকূলমুখী থাকে; কিন্তু ডাঙায় উঠে আর নামা সহজ হয় না বলে অনেক তিমি মারা যায়। এই নামেই এক ভয়াল মৃত্যুজাল পেতে সম্ভাবনার সাইবার দুনিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে জীবনবিচ্ছিন্ন একদল তরুণ। আদতে এটি কোনো গেম নয়, ডাউনলোড করা যায় না। কোনো সাইটে পাওয়া যায় না। বিশেষ কিছু সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে হতাশ ছেলে-মেয়েদের বেছে নিয়ে ওই চক্রটি তাদের সামনে আত্মহত্যার বাজি ছুড়ে দেয়। গেমটি রাশিয়া থেকে ছড়িয়ে ইতিমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অল্প বয়সীদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। কিছুদিন ধরে বাংলাদেশেও মৃদুভাবে আলোচনায় ছিল গেমটি। চলতি সপ্তাহে রাজধানীর এক সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীর আত্মহত্যার পর তার পরিবারেরই একজন সন্দেহবশত ‘ব্লু হোয়েলের’ কথা উচ্চারণ করলে খবরটি ভাইরাল হয়ে যায়। পরে অবশ্য প্রমাণ মেলে, এ আত্মহত্যা ব্লু হোয়েলের কারণে নয়। তবে বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, অভিভাবক মহলে সন্তানদের নিয়ে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত অল্প বয়সীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে আত্মহত্যার বাজি জেতার এই খেলায় সাড়া দিতেও শুরু করেছে, এমন একজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকেরও কথা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিভাবক উদ্বেগের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তাঁরা জানার আগেই স্কুলগামী সন্তানরা গেমটির কথা জেনে গিয়েছে।

বাংলাদেশেও ‘আগ্রহ’ : ‘না, ব্লু হোয়েল না। সে ক্ষেত্রে তো আত্মহত্যা করত ছাদ থেকে লাফ দিয়ে; এইভাবে (ফাঁস) করত না’। ঢাকার স্কুলছাত্রী অপূর্বা বর্ধনের অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন রাজধানীর এক কলেজছাত্রী, যে নিজেও ব্ল হোয়েলের ৫০ ধাপের বাজি ধরার চেষ্টা করছে, ‘কিউরেটর’ অর্থাৎ পাচ্ছে না। অপূর্বার আত্মহত্যার খবর জানাজানির পর এই ছাত্রীটি তার ফেসবুক ওয়ালে ‘বিশেষ’ সাংকেতিক স্ট্যাটাস দিয়ে ব্লু হোয়েল খেলার কথা জানায়। তাত্ক্ষণিক কমেন্টের ঘরে বন্ধুরা উদ্বেগ ব্যক্ত করে মেয়েটির নাম ধরে—‘তোর কী হয়েছে, ঠিক আছস তো’? একজন বলছিল, ‘কেউ ওর বাবা-মাকে জানাও দ্রুত। ’ পরে এই প্রতিবেদক মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন অনলাইনে। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি কালের কণ্ঠকে বলে : ‘আমি তো বলিনি আমি এখনই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি। ’ ছাত্রীটির ফেসবুকে নিজেকে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার বর্ণিল চিত্রকর্ম, উঁচু দালানের ছাদে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছবিও দেখা যায়।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে বাংলাদেশের আরো কয়েকজন তরুণকে ব্লু হোয়েলের ‘কিউরেটর তথা অ্যাডমিনের হ্যাশট্যাগসহ বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন, এমনকি প্রকাশ্যে ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে ‘চ্যালেঞ্জ’ চাইতে দেখা গেছে। একজন তরুণের আইডি খোলা নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে। ছেলেটি গত মাসের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে একবার করে এবং চলতি মাসে এ পর্যন্ত দুইবার অনুরোধ করেছে কোনো একজন অ্যাডমিন যেন তাকে আত্মহত্যামুখী ধাপগুলো শুরু করায়। এখন পর্যন্ত ১৯টি দেশে ব্লু হোয়েলে তরুণ প্রাণ ঝরে পড়ার তথ্য দিচ্ছে উইকিলিকস। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামটি ঢুকেছে চলতি সপ্তাহে, স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিকে অপূর্বা বর্ধনের আত্মহত্যার খবরটির বরাত দিয়ে।

গেমটির উদ্ভাবকদের অন্যতম রুশ তরুণ ফিলিপ বুদেকিনকে (২২) গ্রেপ্তার করা হলে একপর্যায়ে সে স্বীকার করে, সমাজ থেকে হতাশ ছেলে-মেয়েদের সরিয়ে দেওয়ার ভাবনা থেকেই গেমটির উদ্ভাবন করা হয়েছে। মামলায় তিন বছরের জেল হয়েছে বুদেকিনের। মাত্র কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় গেমটির আরো এক কিউরেটর বা অ্যাডমিন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে মোট কতজন অ্যাডমিন রয়েছে, রুশ ছাড়াও অন্যভাষী অ্যাডমিন আছে কি না সে তথ্য পাওয়া যায় না। ভারতে ইউনিসেফ অভিভাবকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ব্লু হোয়েল ছাড়াও গেমটির আরো নাম রয়েছে; যেমন ‘সাইলেন্ট হাউস’, ‘সি অব হোয়েলস’, ‘ওয়াক মি আপ এট ৪ঃ২০’।

কারা বেশি ঝুঁকিতে? : ‘টিএনএজার-ইয়াং অ্যাডাল্টরা, যাদের স্থায়বিক সার্কিটগুলোর বিকাশ এখনো চলছে এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা কম, তারা সেনসেশন, অ্যাডভেঞ্চার ও নতুন বিষয়ে বেশি সাড়া দেয়। দুর্বৃত্তরা এই সুযোগটি নিয়েই অল্প বয়সীদের ‘ফিয়ার সাইকোলজিকে উসকে দেয়। ’ এ ব্যাখ্যাটি এসেছে ‘সাইকোলজিক্যাল ডিটারমিনেশনস অব ব্লু হোয়েল সুইসাইড চ্যালেঞ্জ ভিকটিমাইজেশন : আ প্রপোজিশন ফর দ্য এজেন্সি মেডিএটেড মেন্টাল হেল রিস্ক ইন নিউ মিডিয়া এজ’ শীর্ষক এক সাম্প্রতিক গবেষণায়। এতে বলা হয়, বিশ্বে এই গেমে মৃত্যুর হার ১৩০ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশি ঘটেছে, রাশিয়া, ভারত ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে। উদ্ভাবকের দেশ রাশিয়ায় হার সর্বোচ্চ উল্লেখ করে বলা হয়, গেমটি একের পর এক ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম যে করছে এর কারণ আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি। সামনে ঝুঁকিটি আরো বাড়বে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয় গবেষণাপত্রে।

১৩ রক্ষাকবচ : ব্লু হোয়েলের ভয়াবহ থাবা একের পর এক দেশে দৃশ্যমান হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. সোহেল রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রযুক্তির প্রবাহ বন্ধ করা যাবে না, বিটিআরসির মতো কর্তৃপক্ষ দিয়েও সব উৎস আটকানো যাবে না, যে চেষ্টা এখন ভারত করছে। তবে বিকল্প অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে; যেমন ব্লু হোয়েলের বিপরীতে ইতিমধ্যেই পিংক হোয়েল তৈরি করা হয়েছে; এখানেও ৫০টি ধাপ রয়েছে, যার সবই ইতিবাচক। তিনি লেখাপড়ায় ছোটদের ওপর অহেতুক চাপ না দেওয়ারও পরামর্শ দেন।

সাইবারজগতের অপরাধীরা নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না বলে এক ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এবং সমাজকে বড় রকমের হুমকিতে ফেলে দিতে পারে। এ জন্য রাষ্ট্রের প্রাযুক্তিক কাঠামো যেমন শক্তিশালী করতে হবে, সাধারণ মানুষকেও প্রযুক্তির সর্বশেষ বিষয়গুলোতে আপডেটেড থাকতে হবে।

শিশু মনস্তাত্ত্বিক ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচয়িতা মায়া ভন শা বলেছেন, ব্লু হোয়েলের কথিত নির্মাতাদের মতো ব্যক্তিরা সব সময়ই থাকবে এবং মানসিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের টার্গেট করবে। এসব ব্যক্তিকে হটিয়ে দিয়ে কিংবা অল্প বয়সীদের ইন্টারনেটের বাইরে রেখে সমাধান হবে না। সমাধান প্রথম খুঁজতে হবে পরিবারে। গেমটি নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের জন্য মিয়া ফন চা ১৩টি নির্দেশনা দিয়েছেন, যা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

১. বড়দের প্রধান কাজটি হবে সন্তানের সঙ্গে গভীরভাবে মেশা; অনলাইনে, অফলাইনে মিশুন; তাদের ভাষা বুঝুন। বেশি বেশি কথা বলুন। তাদের জীবন ও অনুভূতি বুঝুন, তাদের বন্ধুদের জানুন। তারা কোন সাইটে বেশি যায় বের করুন। কোনো ওয়েবসাইট জোর করে টেনে বের না করে বরং চেষ্টা করুন এমন নিরাপদ সাইটে সময় দিতে, যেখানে দুজনেরই ভালো লাগে।

২. সন্তানের মূল্যবোধগুলো কী, কিসে তারা প্রাণ পায়, উৎসাহ পায়, সেগুলোর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। এর বাইরে তাদের অর্থপূর্ণ যেসব কাজ করা উচিত সেগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সময় শিশু প্রতিদিনই যাতে পায় তা নিশ্চিত করুন। সবাই কী চাইছে, সমাজ কী আশা করছে কেবল সেসবের পেছনে যদি দৌড়ান সন্তান শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়বে।

৩. বাচ্চাদের বেশি চাপে রাখা বন্ধ করুন। ভবিষ্যতে কী করবে, ক্যারিয়ার কী হবে এখনই এসব নিয়ে অতিমাত্রায় ভাববেন না। শিশুর নিত্যদিনকার চাহিদাগুলো পূরণ করুন। মানুষ হিসেবে মানবিকভাবে মিশুন। তার মানসিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত অবসর সময়ও বের করতে হবে।

৪. সন্তানকে কখনোই ওয়ানসাইডেড বা একপেশে হতে বলবেন না। যদি সারাক্ষণ তাকে বলতেই থাকেন, দয়ালু হও, কঠোর হয়ো না; ভদ্র হও, রূঢ় আচরণ করো না, অন্যের উপকার করো, আলসেমি করো না—তার হতাশা আসবেই। আপনি নিজে যা নন, তা করতে বলবেন, শিশুর কাছে অবাস্তব হয়ে ধরা দেবে, নিজের প্রতি আত্মবিদ্বেষ তৈরি হবে।

৫. সন্তান আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যদি চলে গিয়েই থাকে এবং যদি অসহায় বোধ করেন—এমন বিশ্বস্ত বন্ধু, স্বজন ও থেরাপিস্ট, কোচ, গাইড খুঁজে বের করুন যে আপনার শিশুর সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে (ননজাজমেন্টাল), বন্ধুর মতো মিশতে পারবে।

৬. নিজের মনকে বিশ্বাস করুন। যদি মন বলে কোথাও বড় ভুল হয়ে গেছে, হয়তো তা ঠিক কথাই বলছে। তাই সন্তানের বিষয়ে ঝুঁকি নেবেন না। তার অস্বাভাবিক পোশাকও বড় কিছুর আভাস হতে পারে।

৭. আত্মহত্যার কারণ হতে পারে এমন গেম বা সাইট নিয়ে শিশুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। হতাশার কথা, এই সমস্যা থেকে কারো কারো আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হওয়ার বিষয়টি তাকে জানান। তাকে বুঝতে দিন, কখনো কখনো মানুষ বিপজ্জনক আচরণ করে এবং এ ব্যাপারে ছোট-বড় সবারই সাবধান থাকা উচিত। যদি আপনার বাচ্চা মরে যাওয়ার ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করে ফেলে—একে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। আত্মহত্যা যারা করে তাদের বেশির ভাগই বিষয়টি আগেভাগে একজনের সঙ্গে হলেও শেয়ার করে।

৮. শিশু-কিশোর খাদ্যের তালিকা দেখুন। খুব গুরুত্বপূর্ণ এটি। কিছু পুষ্টির অভাবেও বিষণ্নতা দেখা দেয়। সন্তানকে বিষাদগ্রস্ত দেখালে নিশ্চিত হোন তার খাবারে ওমেগা-৩, ভিটামিন বি৩, ভিটামিন ডি, মাগনেসিয়াম ও প্রোবায়োটিকস আছে কি না। চিনি ও মিহি শর্করা কমানো যেতে পারে।

৯. তাদের আচরণ লক্ষ করুন। ক্ষুধামান্দ্য, ঘুমের এলোমেলো সময়, চোখের নিচে কালো দাগ, নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা, সামাজিকভাবে একা হয়ে যাওয়া, বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ, রাগী ভাব, পছন্দের জিনিসগুলো অপছন্দ লাগা—এ জাতীয় সমস্যায় কথা বলুন।

১০. সন্তানকে বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলুন। কৌশল বাতলে দিন। একটি বিষয় আপনার কাছে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু সন্তান হয়তো অনেক বড় করে দেখছে। যেমন বন্ধুদের টিজিংয়ের শিকার হওয়া, পরীক্ষার চাপ, ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমস্যা, অর্থনৈতিক কারণে হীনমন্যতা, নিঃসঙ্গতা, নিজ পরিবারে সহিংস পরিবেশ, কারোর চলে যাওয়া, মৃত্যু, বিয়েবিচ্ছেদ, নির্যাতন, কারোর মদ্যপানে আসক্তি এসব বিষয় তাকে ভেতরে ভেতরে প্রবলভাবে আলোড়িত করতে পারে।

১১. সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহার কমিয়ে দিতেই হবে এমন নয় (মোবাইল ফোন হাতে না দিয়ে আজকাল পারবেনও না)। তবে শতভাগ নিশ্চিত হোন ইন্টারনেট সংযোগ সে কী কাজে ব্যবহার করছে। ছোটরাও জীবনের অসম্পূর্ণতার বিকল্প খুঁজছে ইন্টারনেটে। যেমন খেলাধুলার সময়, পরিবেশ বা মাঠে যাওয়া হয় না বলেই সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বন্ধুদের সময় দিচ্ছে। মোবাইলে গেম যে খেলে তার কারণ হচ্ছে সেখানে তার যাতায়াতের সুযোগটি অবাধ।

১২. সন্তানকে উপলব্ধি করতে দিন যে তাকে আপনারা ভালো বাসেন, গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমরা অনেকেই অনেক সময় ভেতরের আবেগটা চেপে রাখি। মুখে বলতেই হবে এমন নয়। আলিঙ্গন, চুমু, পিঠ চাপড়ে দিয়ে, হাত-পা ম্যাসাজ—কতভাবেই ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়। তাদের জগত্টা এখন অফলাইনে যেমন, অনলাইনেও। সবভাবেই বুঝুন, ভেতর থেকে, বাইরে থেকে। সন্তানকে জানান, তাকে ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে অর্থবহ কিছু উপহার দিন; যেমন কয়েক লাইনের কবিতা বা ছড়া, কিংবা একটি ফুল—যা তীব্র আবেগ বোঝায়। তাদের চমকে দিন, কিছু বানিয়ে খাওয়ান। সম্পর্কে সৃজনশীল হোন।

১৩. সবশেষে শুনুন, শুনুন, শুনুন। মন দিয়ে শোনার দক্ষতা শিখুন। উপস্থিত থাকুন। শান্ত থাকুন। বেশি প্রশ্ন করা নয়। তাদের ভাবনা অনুসারে সাড়া দিন। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। নিরপেক্ষ থাকুন। সন্তানের উপলব্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, কখনোই না।

ভারতে ইউনিসেফও অভিভাবকদের সতর্ক করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, শিশু-কিশোরদের বয়স-উপযোগী সাইটের বাইরে অন্য কোনো সাইটে যেতে দেওয়া যাবে না। তাদের বলতে হবে প্রকাশ্য স্থানে কম্পিউটার ব্যবহার করতে। শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে হবে অন্য অভিভাবকদের সঙ্গেও। বড়দের তথ্য-প্রযুক্তির সর্বশেষ দিকগুলোর বিষয়ে জ্ঞান রাখলেই হবে না, মোবাইল, ল্যাপটপের মতো ডিভাইসগুলোয় ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ নিয়ন্ত্রণ চালু রাখতে হবে। ভারতে এই গেমের কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা একের পর এক ধরা পড়ায় কয়েক দিন আগে উচ্চ আদালত নির্দেশ দেন, ভারতীয় ওয়েবসাইটগুলোয় গেমটির কোনো লিংক থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে।

বিটিআরসির বিজ্ঞপ্তি : টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য এবং কমিশনের কারিগরি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েব লিংক, অ্যাড্রেস, গ্রুপ এবং অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে বিভিন্ন ক্ষতিকর আসক্তিমূলক, জীবন হানিকর গেমস পরিচালিত হচ্ছে। এসংক্রান্ত তথ্য থাকলে অফিস সময়ে ২৮৭২ নাম্বারে ফোন করে জানানো যাবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া বিটিআরসির সচিব মো. সরওয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, বিটিআরসি ইতিমধ্যেই ব্লু হোয়েল নিয়ে পুলিশের বিশেষ একটি ইউনিটের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে।

তারানা হালিমের পরামর্শ : ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গতকাল ফেসবুকে লিখেছেন, ব্লু হোয়েল গেমটি নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। চেষ্টা চলছে বাংলাদেশে গেমটির কার্যকারিতা, প্রভাব বা ব্যবহার আছে কি না—এর সুনির্দিষ্ট তথ্য জানার। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এর পরও সতর্কতার বিকল্প নেই। বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা শিশু-কিশোরদের কৌতূহলী করে তুলতে পারে বিধায় এ বিষয়ে আমাদের সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। সন্তানদের ব্যবহারিক ও মানসিক পরিবর্তনের প্রতিও অভিভাবকদের সতর্ক থাকা আবশ্যক। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) কাজ করছে। বিটিআরসিকে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ’

ad

পাঠকের মতামত