174156

আয় আরেকটিবার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়: জিলা স্কুলের ২০০০ ব্যাচের মিলনমেলা

ইমতিয়াজ আহমেদ  : ধন্য হোক পুণ্য হোক মোদের বিদ্যালয়, প্রথম পর্ব শেষ হতেই মুক্তমঞ্চে শুরু হয় গানের আসর। শিক্ষক আবদুর রহিম তাঁর প্রিয় পুরানো ছাত্রদের জন্য গান গেয়ে শোনান। পরে স্থানীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ছিল বন্ধুদের স্মৃতিচারণা। কখনো আবেগে কেঁপেছে কারো কণ্ঠস্বর, কখনো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া বন্ধুর জন্য চোখের পানিও পড়েছে। কখনো মনে পড়েছে পড়াশোনা নিয়ে সংগ্রামের কথা, খেলার কথা। দিনগুলো যে কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।

 

            

 

‘ অটুট বন্ধন ২০০০ ব্যাচ ’ লেখা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে ১৭ বছর পর আবারো চিরচেনা আপন ঘরে মহামিলন ঘটলো গ্যালাকটিকোদের অর্থাৎ কুমিল্লা জিলা স্কুলের ২০০০ ব্যাচের মহাতারকাদের। যে ব্যাচের প্রত্যেকেই স্বমহিমায় ভাস্বর একেকটি গ্যালাকটিকো। এ মহাতারকা মেলায় আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন স্বপ্নসারথীরা। স্বপ্নসারথীরা হল সেই সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তি শিক্ষকবৃন্দ। গ্যালাকটিকো ও জীবন্ত কিংবদন্তি শিক্ষকদের উপস্থিতিতে আলোকজ্জ্বল, গৌরবজ্জ্বল ও স্মরণীয় এ মিলনমেলা জিলা স্কুলের ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।

 

সবার প্রিয় শিক্ষক তাজুল ইসলাম স্যার। তাঁর বেত এর নাম ছিল মেড ইন জাপান। তিনি বলেন, আমার প্রান প্রিয় ছাত্ররা যারা  আমাকে  স্বরণ করে তারা বেতের কারনে করে। আর বেতটি প্রয়োগ করা হতো তাদের স্বার্থে।

 

তার ভিডিও লিংকটি :

নতুন নতুন চমকে ভরপুর ছিল ৯ ঘন্টাব্যাপি এ মিলনমেলা। আসা যাক মহামিলনের অনুষ্ঠান মালায়।

 

ঈদের পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর। ঘড়ির কাটায় দুপুর ২ টায় । ব্যাংক-ট্যাংকের ঐতিহ্যে ভরপুর, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, উপমহাদেশের প্রাচীন শহর কুমিল্লার শিক্ষার অগ্রদূত কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রাঙ্গণে হাজির হতে শুরু করলো হলুদের আবরণে সজ্জিত আলোকোজ্জ্বল মহা তারকারা। হৃদতাপূর্ণ আলিঙ্গণে একে অপরের সাথে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হল।

 

 

জমে থাকা বুকের মাঝে হাজারো কথাগুলো অর্নগল বলে যাচ্ছে একে অপরকে। অতীতের আড্ডাখানা, প্যারেড গ্রাউন্ড, ধর্মসাগর পাড়, সেই খেলার মাঠে পদচারণা করে নষ্টালজিয়ায় মত্ত হলেন ২০০০ ব্যাচের তারকারা। গ্রুপ ছবি ধারণ, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং খেলার মাঠে হাতে হাত ধরে বিশাল সারিতে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ঐক্যের বন্ধন যে সুদৃঢ় তা আবার আলোকচিত্রের ক্যামেরায় তুলে ধরলেন তারকারা। রাইসুল ইসলাম নাবিল, সাইফুল ইসলাম (জুয়েল), শাহিনুর, আশিক, জুয়েল কাজী, সাইদুল, আলী রেজা হায়দার, আল আমিন, পিয়াস মজিদ, ছোটন, তানিন, মাকসুদ, মামুন, রায়হান, রাব্বি, ফারিয়াল, তন্ময়, রিয়াজ, কামরুল হাসান বাবু, জোবাায়ের, শিশির, মুকিম, সাইফ, সোহাগদের দুষ্টামিতে, অতীতের কমন ডায়লগগুলো ফিরে আসছিল বারবার। যেন সবাই ফিরে গেছে সেই ১৭ বছর আগের সেই দিনগুলোতে। কথা, চলনে সেই দুরন্তপনা, দুষ্টামি যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল সেই ২০০০ সাল বহমান । জুয়েল তার ডে-শিফটের বন্ধু জনিকে স্মরণ করিয়ে দিল – “ মনে আছে রে, টসে জিতে আগে আমরা ব্যাট করতাম। পরে ফিল্ডিং না করেই চলে যেতাম।” ডে শিফটের জন্য সে সময়টা হতাশার থাকলেও আজ সেই মহামিলনের দিনে যেন তা মধুর স্মৃতিই মনে হল। সবার মাঝে ছিল হাসি। প্রভাতি-ডে শিফট বলতে কিছু ছিল না। সবার মুখেই একই কথা-আমরা ২০০০ ব্যাচ।

 

 

বিকেল ৪ টায় আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে গন্তব্য নগরীর পার্ক সংলগ্ন নজরুল ইন্সটিটিউটে। সেখানে অপেক্ষা করছিল মূল চমক। বিশাল এক কেক কাটার অপেক্ষায় । সাড়ে ৪ টায় কেক কাটা অনুষ্ঠানে হাজির হলেন একে একে ৩ স্বপ্নসারথী শিক্ষক। সকল শিক্ষার্থী দাড়িয়ে তাদের শ্রদ্ধাভরে স্বাগতম জানালো। এ যেন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক প্রবেশের পর দাড়িয়ে সম্মানের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিল। সাবেক প্রধান শিক্ষক মমতাজুর রহমান স্যার , আবদুল ওয়াহাব স্যার ও প্রভাতি শাখার সাবেক শিক্ষক চিরসবুজ আব্দুর রহিম স্যার কেক কেটে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন। এবার শুরু হল আলোচনা ও সম্মাননা অনুষ্ঠান। ১২ জন শিক্ষক ততক্ষণে এসে হাজির হলেন।

 

 

প্রকৌশলী মাহফুজুল হক মাসুমের নকশায় জমকালো মঞ্চে অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় আসলেন রাইসুল ইসলাম নাবিল। প্রথমে মহিবুবুল হক ছোটন লিখিত স্বাগত বক্তব্য দিলেন। এরপর আসলেন তরুণ কবি পিয়াস মজিদ। প্রয়াত শিক্ষক ও বন্ধুদের স্মরণ করে একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন। এরপর অতীত স্মৃতি রোমন্থন করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারি পরিচালক শিশির, এনটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক আহমেদ আল আমিন, উজ্জ্বলরা।

 

 

এরপর বক্তব্য রাখলেন ওই সময়ের পথ প্রদর্শক শিক্ষক মমতাজুর রহমান, এ কে এম হাবিব উল্লাহ, মো. মনিরুজ্জামান, মো. মোসলেহ উদ্দিন, তাজুল ইসলাম, খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, আবদুর রহিম, আবদুল ওয়াহাব, আসমা আক্তার, সুদীপ্তা রানী রায়, আজিজুন্নেসা ও বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা আক্তার। পরে শিক্ষকদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ২০০০ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি চাদঁর, ঘড়িও উপহার হিসেবে দেওয়া হয় । আলোকচিত্রে ধারণ করা হয় স্মরনীয় মুহূর্তগুলো। এরপর প্রয়াত শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত টি শার্ট তার বন্ধুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যা তাদের পরিবারের কাছে পৌছে দেওয়া হবে। লিমনের সৌজন্যে ২৪টি দেয়াল ঘড়ি জিলাস্কুলের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের জন্য প্রধাণ শিক্ষিকা রাশেদা আক্তারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

 

 

প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা আক্তার বলেন, সাবেক ছাত্র হিসেবে তোমরা সব সময় স্কুলের উন্নয়ন নিয়ে পরামর্শ দেবে এই আশাই আমরা করি।
এরপর রি-ইউনিয়ন আয়োজনে অবদান যারা রেখেছেন তাদের সবাইকে নাম সম্বলিত টি-শার্ট উপহার দেওয়া হল। ফেসবুকের মাধ্যমে সবাইকে একত্রিত করার জন্য রাজশাহীর কাস্টমস কর্মকর্তা আলী রেজা হায়দার (পিয়াস) এবং অনুষ্ঠানটি সফল করতে অবদান রাখা মহিবুবুল হক ছোটন, প্রকৌশলী মাহফুজুল হক মাসুম , জুয়েল কাজী, পাভেল, হাসানুজ্জামান তানিন, শাহাদাত সোহাগ আইটিপি, রিয়াজ, আসিফ ইকবাল, বশিরুল আলম পাটোয়ারীকে নাম সম্বলিত টি শার্ট উপহার দেওয়া হয়।

 

 

আলোচনাসভা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় মুক্তমঞ্চে গানের আসর। ততক্ষণে সকল শিক্ষক সবাইকে বিদায় জানিয়ে যার যার গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। তিনি শিক্ষক আবদুর রহিম । রাত ৮ টায় বি-বাড়িয়া যাওয়ার তার শেষ ট্রেন থাকলেও তিনি রেলস্টেশন না গিয়ে প্রিয় শিক্ষার্থীদের আরো কিছু দেওয়ার জন্য রয়ে গেলেন। টানা তিনটি গান গেয়ে শোনালেন তাঁর প্রিয় পুরানো ছাত্রদের । শিক্ষার্থীরাও দাড়িয়ে -হাত তালি দিয়ে সম্মান জানালেন প্রিয় শিক্ষক আব্দুর রহিমকে। পরে অডিটোরিয়ামে স্থানীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন।

 

 

সময় স্বল্পতার জন্য তুহিনের গান, শাফিন জোবায়ের জিতুর কবিতা আবৃত্তি, সাইফুল ইসলাম জুয়েল, কামরুল ইসলাম, এড মুকিম, আলী রেজা হায়দারদের স্মৃতিচারণ হয়তো শোনা হলনা। তবে হতাশ নই। হয়তো আবার কোন এক সময় আরো জমকালো মিলনমেলায় তুহিন তার ক্লাসিক গানে মাতোয়ারা করবেন সবাইকে। শাফিন জোবায়ের জিতুর ভরাটকন্ঠে মনোমুগ্ধকর আবৃত্তি সবাইকে আবার ভাবুক করবে তুলবে। এভারগ্রীণ খ্যাত রহিম স্যারের প্রাণোচ্ছল বক্তব্য আর সংগীত আবার প্রেরণা জোগাবে নিজেদের প্রফেশন সমৃদ্ধ করণে।

 

 

টানা ২৬ ঘন্টা না ঘুমিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পার করে সাকিব এবং কামাল সিডনি থেকে এসেছে এই মহামিলনে অংশ নিতে। আরো অনেকে কর্মব্যস্ততার মাঝেও ১৭ বছর পর আতুড় ঘরে ফিরলেও দূর প্রবাসে থাকা, কিংবা সময় সংকটে আসতে না পারা নাদির, শওকত ইসলাম সোহেল, আরিফুল ইসলাম ডল, মুন্সি জুমরাদ আহমেদ, রেশাদ, অনুপ, সবুজ, মুহিত চক্রবর্তী, কাইয়ূমদের মিস করেছে সবাই। আশাই থাকলাম। হয়তো পরবর্তী অনুষ্ঠানে তাদের থাকবে সজীব উপস্থিতি।

 

 

ভালবাসা রইল ঐসব বন্ধুদের প্রতি, যারা এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনে সহোযোগীতা করে এবং যারা অংশ গ্রহন করে। সারাজীবন এই বন্ধন যেন অটুট থাকে কুমিল্লা জিলা স্কুল ২০০০ ব্যাচের। ভালবাসা আছে, থাকবে অবিরাম। আমরা এক অটুট বন্ধন।

 

ad

পাঠকের মতামত