173475

রাম রহিম যে কারণে মেয়েকে জেলে একসাথে চেয়েছিল

দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ভারতের ‘ধর্মগুরু’ গুরমিত রাম রহিমকে নিয়ে যখন আদালত চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার তখন তার পাশে বসে থাকা এক মহিলার পরিচয় নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অবশ্য সব ধোঁয়াশা পরিষ্কার হয়ে যায়। জানা যায় ইনি নাকি গুরমিতের তৃতীয় কন্যা, হানিপ্রীত।

তবে এই মুহূর্তে আরো বেশি আলোচ্য বিষয় হল, গুরমিত এবং হানিপ্রীত দু’জনেরই একান্ত ইচ্ছা ছিল, রোহতাকের জেলে তাদের যেন একসঙ্গে রাখা হয়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর রাম রহিম এবং হানিপ্রীত দু’জনেই পঞ্চকুলার সিবিআই আদালতে আবেদন রেখেছিলেন যাতে তাদের জেলে একসঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ডেরা সচ্চা সৌদার প্রধান ফর্মাল পিটিশন দায়ের করেছিলেন। অন্যদিকে হানিপ্রীত তার আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেছিলেন। তার বক্তব্য তিনি আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ এবং বাবা রাম রহিমের মাইগ্রেন এবং পিঠের ব্যাথার চিকিৎসা একমাত্র তিনিই করতে পারবেন।

সিবিআই আদালত অবশ্য আবেদন খারিজ করে দিয়ে জানায়, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার এবং জেল কর্তৃপক্ষেরই রয়েছে। এর পর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে রাম রহিম এই আবেদন রাখেন। জেলের পক্ষ থেকে যখন জানানো হয় একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীকে একসঙ্গে জেলের ভিতর থাকতে দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই, তখন জেল কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেন ডেরা প্রধান। বলেন, যদি হানিপ্রীতকে তার সঙ্গে থাকতে দেওয়া না হয় তাহলে তাদের প্রত্যেককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করিয়ে ছাড়বেন।
প্রভাবশালী গুরমিত রাম রহিমের পক্ষ থেকে এতটাই চাপ সৃষ্টি করা হয় যে, অবশেষে জেল কর্তৃপক্ষ হানিপ্রীতকে ডেরা প্রধানের সঙ্গে প্রায় ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট জেলের ভিআইপি অবসর কক্ষে একা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে এতেও শান্ত করা যায়নি বাবা ও তার কন্যাকে! তাদের দাবি ছিল রাতেও একসঙ্গে থাকতে দিতে হবে। তাতে জেল কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় আরও বেশ কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি চালান দু’জনেই।

ফেসবুক প্রোফাইলে নিজেরে পাপাজ পরি বলে পরিচয় দেন হানিপ্রীত। প্রিয়াঙ্কা তানেজা ওরফে হানিপ্রীতকে ২০০৯ সালে দত্তক নেন গুরমিত।

এদিকে, ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত গুরমিত রাম রহিমের সাজা আজ ঘোষণা হচ্ছে। সাজা ঘোষণা করবেন সিবিআই বিচারক জগদীপ সিং। সোমবার রোহতক জেলা সংশোধনাগারে গিয়ে ওই সাজা ঘোষণা করবেন বিচারক। সাজা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত রোহতক-সিরসায় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করার পর সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে সাজা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আশঙ্কায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এছাড়া রোহতক সিরসার বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে নয় হাজার আধা-সামরিক ও বিশাল পুলিশ বাহিনী। মোড়ে মোড়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চলছে। মোবাইল সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি পাঞ্জাবের ১৩টি জেলায় স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভক্ত নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে আদালত গত ২৫ আগস্ট রাম রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করে।
সাধু বাবার সেবায় নিয়োজিত ছিল ২০০ সুন্দরী!

প্রায় হাজার একর জমির মাঝখানে আয়নায় মোড়া এক প্রাসাদ। তার নাম ‘বাবা কি গুফা’। দামি আসবাব, সোফা, পর্দায় সাজানো বিলাসবহুল সেই প্রাসাদেই বাস গুরমিত রাম রহিম সিংহের।
গুফায় তাকে ঘিরে থাকেন ২০০ জনেরও বেশি বাছাই করা শিষ্যা। তাদের চুল খোলা। পরনে সাধ্বীদের মতো দুধসাদা রঙের পোশাক। এরাই রাম রহিমের যত্নআত্তি, দেখভাল করেন।

এমনই দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বাবা রাম রহিম। এক সময়ে বাবার ‘গুফা’য় অতিথি হওয়া বিহারের সাংবাদিক পুষ্পরাজ জানিয়েছেন, সেখানে আছে মেয়েদের স্কুল ‘পরীলোক’। তার সব পড়ুয়াই সুন্দরী। কারণ, বাবাজি মনে করেন ‘খুবসুরত’ হলেই মেধাবী হয়।

সেই গুফায় প্রবেশাধিকার আছে মাত্র কয়েক জনের। তাও আঙুলের ছাপ, চোখের মণি-র মতো বায়োমেট্রিক তথ্য মিললে তবেই ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। ধর্মগুরু হলেও রাম রহিমের পছন্দ শিফনের রঙবেরঙের জামা, বাহারি জুতো। তার জামাকাপড় তৈরির জন্য নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার রয়েছেন। রয়েছেন নিজস্ব ‘হেয়ার ড্রেসার’-ও।

রাম রহিমের কনভয়ে বিলাসবহুল ১০০টি গাড়ি। তার মধ্যে ১৬টি কালো রঙের ফোর্ড এনডেভার। বাবা প্রাসাদ থেকে বের হলে সব গাড়ি তাবু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বাবা নিজেই ঠিক করেন, তিনি কোন গাড়িতে উঠবেন। আশ্রমে নিজের ব্যাটারিচালিত গাড়িতেই ঘোরেন তিনি।

সিরসায় ডেরা সচ্চা সৌদার এই সদর দফতর আসলে নিছক আশ্রম নয়। ছোটখাটো শহর। ডেরা-র ভিতরেই চাল, ডাল, আনাজের চাষ হয়। হোটেল, সিনেমা হল, স্কুল, রেস্তোরাঁ, মাল্টি-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, স্টুডিও, বায়ো-গ্যাস কারখানা, পেট্রোল পাম্প, সংবাদপত্রের ছাপাখানা— সবই রয়েছে। এক সঙ্গে ১০ হাজার জামাকাপড় কাচার ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াশিং মেশিনও রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কন্ট্রোল রুম, গোটা ডেরা জুড়ে নজরদারি ব্যবস্থা।

ডেরা-র বাইরেও রাম রহিমের দাপট কম নয়। ডেরা সচ্চা সৌদা সিরসায় একটি নিজস্ব বাজার তৈরি করেছে। সেখানে সব দোকানেরই নাম শুরু সচ্ দিয়ে। সিরসা ছাড়াও দেশেবিদেশে আরো ৪৬টি আশ্রম রয়েছে রাম রহিমের। রাম রহিম নিজেকে ‘মেসেঞ্জার অফ গড’ বলেন। তার ‘এমএসজি’ ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু-তেল-সাবানের মতো হাজারো সামগ্রীর ব্যবসাও চলে এই আশ্রম থেকেই। আশ্রমে রাম রহিমের প্রবচন শুনতে দিনে গড়ে ৩০ হাজার লোক জড়ো হয়। মাত্র ছ’মিনিট ভক্তদের উপদেশ দেন। তার পরেই মঞ্চে ডিজে উঠে গান বাজাতে শুরু করেন।

মাত্র দু’সপ্তাহ আগেই সিরসার ডেরা-য় ‘মিউজিক্যাল কার্নিভাল’এর আয়োজন হয়েছিল। ১২ অগস্ট রাতের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন অন্তত ৭০ লক্ষ মানুষ। মাঝরাতে মঞ্চে ওঠেন রাম রহিম। অদ্ভূতদর্শন লাল রঙের আলো ঝলমলে গাড়িতে। তার পর গান শোনাতে শুরু করেন। জলসা চলে রাত তিনটে পর্যন্ত। রাম রহিম অবশ্য শ’খানেক কনসার্ট করেছেন। বাবাজি ১৫ অগস্টেই ৫০ বছরে পা দিলেন। সেদিন ৩ ইঞ্চি মোটা, ৪২৭.২৫ বর্গফুটের কেক তৈরি হয়েছিল। তার উপরে একসঙ্গে দেড় লক্ষ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল।

ধর্মগুরু রাম রহিম অবশ্য সংসারী। স্ত্রী হরজিত কউর ও তার এক পুত্র ও দুই কন্যাও রয়েছেন। এ ছাড়াও একটি কন্যা দত্তক নিয়েছেন তিনি। মেয়েরা তার সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। ছেলে জসমিতের বিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা হরমেন্দ্র সিংহ জস্‌সির কন্যার সঙ্গে। বড় মেয়ে চরণপ্রীতের দুই ছেলে রয়েছে। বাবাজি আদর করে নাতিদের নাম দিয়েছেন সুইটলাক ও সুবাহ-এ-দিল।

ad

পাঠকের মতামত