বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে
পুরো ইতিহাসজুড়েই অনুসন্ধানকারীরা কিংবদন্তির সেই চিরযৌবন লাভের ফোয়ারার সন্ধান করেছেন। কল্পনার রাজ্যের এই ফোয়ারার এখনো কোনো সন্ধান মেলেনি। তবে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মানুষ পুরো বিশ্বের মানুষের গড় বয়সের (৭১) চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। প্রতিটি দেশেরই দীর্ঘায়ু হওয়ারা ভিন্ন ভিন্ন গোপন রহস্য রয়েছে।
২০১৭ সালের বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর তালিকায়ও এই দেশগুলো শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবাদ সংস্থা বিবিসি দেশগুলো ঘুরে সেখানকার মানুষদের দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কী সেই রহস্য…
১. জাপান
জাপানের মানুষেরা গড়ে ৮৩ বছর বাঁচেন। জাপানের মানুষেরাই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘায়ু হন। জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় ‘দ্য ল্যান্ড অফ ইমরটালস’ বা ‘অমরদের দেশ’। দক্ষিণ জাপানের এই দ্বীপপুঞ্জে একটি বিশ্ব দীর্ঘায়ু গবেষণা কেন্দ্র আছে। কেননা এই দ্বীপপুঞ্জে ১০০ বছর বয়সী মানুষ আছেন ৪০০ জন।
এই দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের দীর্ঘায়ু হওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসে। এখানকার বাসিন্দারা প্রতিদিন টফু নামের একটি বিশেষ ছানা জাতীয় খাবার এবং মিষ্টি আলু ও অল্প পরিমাণে মাছ খায়। সয়া দুধ থেকে বানানো হয় এই টফু নামের খাবার। এ ছাড়া তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে বয়স্কদের সামাজিক চক্র এবং শক্তিশালী সম্প্রদায়বদ্ধ জীবনযাপন। এখানকার মানুষরা সম্প্রদায়বদ্ধভাবে জীবনযাপন করে বলে তাদের মধ্যে মানসিক চাপ কম থাকে এবং একাত্মতার অনুভূতিও প্রবল থাকে। যা তাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে এবং আরো বেশিদিন বেঁচে থাকতে সহায়তো করে।
২. স্পেন
ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাস স্পেনীয়দের দীর্ঘায়ু হওয়ার মূল রহস্য। যাতে রয়েছে হৃদপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল, সবজি এবং সুস্বাদু ওয়াইন। তবে স্পেনীয়দের দীর্ঘায়ু লাভের আরেকটি রহস্য হলো- সিয়েস্তা বা দিবানিদ্রা।
স্পেনের মানুষেরা প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘুমান। অফিস-আদালত সহ সব জায়গাতেই তাদের কাজের শিফট এভাবেই বণ্টন করা থাকে। দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করার পর বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ফের কাজে যোগ দেন স্পেনের মানুষরা। এ ছাড়া স্পেনের মানুষেরা প্রচুর হাঁটেন। বাজারে বা দোকানে তারা পায়ে হেঁটেই যান। এছাড়া অফিসে যেতেও লোকে বেশিরভাগই গণপরিবহন ব্যবহার করে। এবং ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে বরং বাইসাইকেলে চড়ে যাতায়াত করেন।
৩. সিঙ্গাপুর
দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই উন্নত। আর এই চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণেই নাকি সিঙ্গাপুরবাসীরা গড়ে ৮৩.১ বছর করে বাঁচেন। দেশটিতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যর হারও খু্বই কম। দেশটির স্বাস্থ্যসেবার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো রোগ প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা করা।
দেশটির সংস্কৃতি এবং সহজে প্রবেশযোগ্য শহুরে পরিবেশও সেখানকার মানুষদের দীর্ঘায়ু হতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। সিঙ্গাপুরবাসীরা নিয়মিতভাবে জিমে এবং পার্কে গিয়ে শরীরচর্চা করেন। সম্প্রতি দেশটিতে প্রথম একটি থেরাপিউটিক পার্ক খোলা হয়েছে। এটি স্থাপন করা হয়েছে, বয়স্কদের মানসিক চাপ কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে।
দেশটিতে ধূমপান এবং মদপানের মতো স্বাস্থ্য ধ্বংসকারী অভ্যাসও বেশ ব্যয়বহুল। দেশটিতে সিগারেট ও মদের দাম অনেক বেশি রাখা হয়। সরকার কর বাড়িয়ে দিয়ে এসবের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
৪. সুইজারল্যান্ড
দেশটির মানুষেরা গড়ে ৮১ বছর পর্যন্ত বাঁচেন। ইউরোপের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি এই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই উন্নত। দেশটির বাসিন্দারা পনির এবং দুধজাতীয় খাদ্য বেশি খান। এটিও তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার একটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত হয়। দেশটির মানুষরা ক্যারিয়ার খুব বেশি সচেতন হওয়া সত্ত্বেও তাদের অবসর কাটানোর সুযোগ আছে প্রচুর। সপ্তাহান্তের ছুটিতে পুরো ইউরোপ এবং আল্পস পর্বতমালায় ভ্রমণে যাওয়া যায়। দেশটির প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত।
৫. দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়াই প্রথম দেশ যেখানকার মানুষেদের গড় বয়স প্রথমবারের মতো ৯০ ছুঁয়েছে। দেশটির শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিই এর কারণ বলে অনেকের ধারণা। দেশটির স্বাস্থ্যসেবা খুবই উন্নত এবং গণমানুষের সেবায় নিয়োজিত। আর পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার মানুসের রক্তচাপ অনেক কম যা তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার আরেকটি বড় কারণ।
আর দেশটির মানুষদের খাদ্যাভ্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে ফার্মেন্টেড বা গাঁজানো খাবার। যা দেহে কোলোস্টেরল কমিয়ে রাখে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আর সার্কিভাবে কোরিয়ানরা আঁশযুক্ত ও পুষ্টিতে ঠাসা খাবার বেশি খান।
সম্প্রদায়বদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ জীবন-যাপনের ফলে তাদের জীবনের গুনগত মানও বেশি। দেশটির গণ গোসলখানাগুলো মানুষকে আরো বেশি সামাজিকতা এবং বিনোদন যোগায়। এ ছাড়া বৌদ্ধ সংস্কৃতি থেকে আসা মনোযোগপূর্ণ এবং সহযোগিতার মনোভাবও তাদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করেছে। দেশটির মানুষেরা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চেয়ে বরং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাবই লালন করেন বেশি। এসব কিছু তাদের দীর্ঘায়ু পেতে সহায়ক হয়।
সূত্র : বিবিসি