আফসানাকে হত্যা মামলা ধামাচাপার ভয় পরিবার ও সহপাঠীদের

Afsana-Thakurgaon Killedশ্বাসরোধেই মিরপুর সাইক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আফসানা ফেরদৌসীর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁকে ধর্ষণ বা তাঁর অন্তঃসত্ত্বা থাকার আলামত মেলেনি।

আফসানার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন, আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ঘটনাটি আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড তা বোঝা যাবে না। এদিকে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যুর পর হত্যার অভিযোগ উঠলেও পুলিশ অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাসহ অন্যদের আটক করেনি। থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। অবশ্য পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েই ঘটনাটির তদন্ত করছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে আফসানার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ঢাকায় পড়তে এসে আফসানার এমন পরিণতিতে এলাকাবাসী চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল খায়ের মো. সফিউজ্জামান বলেন, আফসানার গলায় দাগ ছিল। এটা আত্মহত্যা না হত্যা এখনই বলতে চাই না। সেটা মন্তব্য করা হয়ে যাবে। তবে শ্বাসরোধে নিহত হয়েছেন আফসানা। তিনি আরো বলেন, ‘ময়নাতদন্তে বিস্তারিত সবই দেখা হয়। প্রথমে তাঁকে শনাক্ত করতে না পারা এবং পরবর্তী সময়ে পরিচয় শনাক্ত হওয়ার কারণে আমরা ডিএনএ প্রোফাইলিং করছি।’ এ ছাড়া গলায় অর্ধচন্দ্রকার দাগ থাকার পুলিশি দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব আমি আর বলতে চাই না। তবে শ্বাসরোধে মৃত্যু এটা নিশ্চিত।’ তবে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি এবং আফসানা অন্তঃসত্ত্বাও ছিলেন না বলে জানান তিনি। আত্মহত্যা করলে শারীরিক কী কী পরিবর্তন আসে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কী বুঝতে পারছেন—এমন প্রশ্ন করা হলে সফিউজ্জামান বলেন, ‘এটা বললেই মন্তব্য করা হয়ে যায়। আমি এখন কিছু জানাব না। রিপোর্টে সব জানা যাবে।’

এদিকে পরিবারের পাশাপাশি আফসানার সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন থেকেও দাবি করা হয়েছে, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের নেতা রবিন ও তাঁর সহযোগীরা আফসানাকে হত্যা করেছে। অন্যান্য অনেক ঘটনার মতো এটিকেও আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে তারা।

কাফরুল থানার ওসি শিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন বলেন, ‘গত শনিবার যখন লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়, তখন তাঁর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কেবল গলায় স্পষ্ট একটা দাগ ছিল। এর পরও আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, লাশ যখন আনা হয়, তখন কোনো ধস্তাধস্তি বা কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়নি এ কথা ঠিক। কিন্তু আত্মহত্যায় যে ধরনের পরিবর্তন আসে চেহারায়, তেমন কিছুও দেখা যায়নি।

শনিবার নিহত অবস্থায় পাওয়ার পর থেকে তাঁর পরিবারের কাছে টেলিফোনে ‘সমঝোতার প্রস্তাব’ যায় তেজগাঁও কলেজের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনের পক্ষ থেকে। এরপরই আফসানার পরিবারের শঙ্কা, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা হওয়ায় বিভিন্ন রিপোর্ট ও তদন্তে হস্তক্ষেপ করতে পারেন রবিন। তবে বুধবার থেকে সব কটি গণমাধ্যমে সংবাদ ও ফোন নম্বরগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আর কোনো ‘সমঝোতা’র জন্য ফোন আসেনি উল্লেখ করে আফসানার ভাই ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আমাদের বোন আত্মহত্যা করতে পারে না। আর তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে, সেখানে সে আমার সঙ্গে ঈদের পরিকল্পনা পর্যন্ত করেছে। এখন আমাকে বললেই হলো, সে আত্মহত্যা করেছে।’ এদিকে আফসানা ফেরদৌসীর মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত বুধবার রাজধানীর শাহবাগে ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।

আফসানার বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কানিকশালগাঁওয়ে। তিনি মিরপুরের মানিকদি রোড এলাকার একটি মেসে থেকে পড়াশোনা করতেন। ছয় মাস আগে তাঁর বাবা আখতার হোসেন মারা যান। এর মধ্যে আফসানার মৃত্যুতে পুরো পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

সাইক শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন:
এদিকে স্থাপত্যবিদ্যা টেকনোলজির ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী আফসানা ফেরদৌস ‘হত্যার’ বিচার দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে তার সহপাঠীরা। এসআইএমটির শেওড়াপাড়ায় সাইক ক্যাম্পাসের সামনে শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন করে। এতে সংহতি জানিয়ে অংশ নেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। মানববন্ধন-পরবর্তী সমাবেশ থেকে আফসানা হত্যার বিচার দাবি করে ছাত্রছাত্রীরা বলে, ‘গত ১৩ আগস্ট আফসানার লাশ হাসপাতাল মর্গে পাওয়া যায়। এর আগের সব ঘটনাই রহস্যজনক। অবস্থা পর্যবেক্ষণে আমাদের ধারণা—এটা হত্যাকাণ্ড। ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। তবুও এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

এলাকায় ক্ষোভ, বাড়িতে মাতম:

আফসানার পরিবার ও গ্রামে শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে। আফসানার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে (বুধ ও বৃহস্পতিবার ) ঠাকুরগাঁওয়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহল থেকে মানববন্ধন করা হয়েছে।

আফসানার মা সৈয়দা ইয়াসমিন অভিযোগ করে বলেন, রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে রবিন ও তাঁর কয়েক বন্ধু মিলে আফসানাকে হত্যা করেছে। এটি ধামাচাপা দিতে আত্মহত্যার নাটক সাজানোর চেষ্টা করছে তারা। আফসানার ছোট বোন আফিয়া আরফিন বলেন, বড় বোন আফসানা তাঁর বন্ধুর মতো ছিল। কিছুদিন আগে আফসানা তাঁকে বলেছিল রবিন নামে এক ছেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক রয়েছে।

আফসানার ভাই ফজলে রাব্বী বলেন, সোমবার থেকে বিভিন্ন সময় অপরিচিত নাম্বার থেকে রবিন ও তাঁর বন্ধু পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে এ বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্য। মীমাংসার জন্যও চাপ দেওয়া হচ্ছে বারবার। বলা হচ্ছে, মিডিয়া ও থানা পুলিশ তারা কিছুই করতে পারবে না। রাব্বী আরো বলেন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাঁর বোনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যেন সঠিকভাবে বের করা হয়। তনুর মতো যেন তাঁর বোনকে কবর থেকে পুনরায় না উত্তোলন করা হয়।

উল্লেখ্য, গত শনিবার বিকেলে দুজন যুবক সিএনজিতে করে আফসানাকে মিরপুরের আল-হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তির জন্য স্ট্রেচার নিয়ে আসতে বলে তারা সিএনজির ভাড়া মেটাতে যাচ্ছে বলে সটকে পড়ে। কর্তব্যরত চিকিৎসক বলছেন, হাসপাতালে আনার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। পরে পুলিশ তাঁর লাশ উদ্ধার করে।

ad

পাঠকের মতামত