মামলা দিয়ে আয় না হলে সরকার কিভাবে আমাদের বেতন দেবে: ওসি

oc---daudযানবাহনে মামলা দিয়ে গাজীপুর থেকে মাসে ৩২ লাখ টাকা আদায় করতেই হবে। আর এ টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনে মামলা দিয়ে থাকে। শুধু টার্গেটকৃত টাকা আদায়ের জন্য মামলা দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত- এমন প্রশ্নে গাজীপুর-সালনা হাইওয়ে পুলিশের ওসি মোহাম্মদ দাউদের জবাব, ‘মামলা দিয়ে রাজস্ব আদায় না হলে সরকার কিভাবে পদ্মা সেতু বানাবে? কিভাবে আমাদের বেতন-ভাতা দেবে?’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করতে মহাসড়কে ট্রাক থামাতেই হবে।’

প্রসঙ্গত, গাজীপুর হাইওয়েতে প্রায় সারাক্ষণ যানজট লেগে থাকে। বেশির ভাগ সময় মাইলের পর মাইল দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়ে গাড়িচালক থেকে শুরু করে যাত্রীসাধারণের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা রাস্তায় শেষ হয়ে যায়। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তোষের শেষ নেই। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, তারা শত চেষ্টা করেও যানজট সামাল দিতে পারে না। হাইওয়ে পুলিশের মামলা অভিযানের কারণে যেখানে সেখানে গাড়ি আটকে দেয়া হয়। এ কারণে যানজট নিরসনে জেলা পুলিশের কোনো উদ্যোগ হাওয়েতে তেমন কাজে আসছে না।

সূত্র বলছে, গাজীপুর সড়ক অঞ্চলে হাইওয়ে পুলিশের ৩০টি থানা ফাঁড়ি রয়েছে। এসব ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে প্রতি মাসে টার্গেটকৃত ৩২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। তবে এই টাকা আদায় করতে গিয়ে কর্তাব্যক্তিসহ হাইওয়ে পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য নিজেদের পকেট ভারি করে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে যদি খাতা-কলমে ১শ’ মামলা করা হয়, সেখানে বাস্তবে গাড়ি থামানো হয় এর দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। অবশিষ্ট গাড়ি থেকে মামলার ভয় দেখিয়ে নগদ টাকা তোলা হয়। যাকে গাড়িচালকরা সহজ ভাষায় বলে থাকেন হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি। আর অভিযোগের তীর সবচেয়ে বেশি সালনা হাইওয়ে পুলিশের ওসি মোহাম্মদ দাউদের দিকে। বাড়ি ফরিদপুর হলেও তিনি সব সময় নিজেকে গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, গাজীপুরে সালনা হাইওয়ে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে যানবাহন থেকে টাকা আদায়, যানবাহনের কাগজপত্র দেখার নামে চালক ও যাত্রীদের হয়রানি করাসহ বহুবিধ অভিযোগ রয়েছে। তবে অনেকে প্রতিবাদ করার সাহস পান না বলে এদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর সালনা হাইওয়েতে যোগ দেন ওসি মোহাম্মদ দাউদ। গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কালিয়াকৈর চন্দ্রা হয়ে নবীনগর ও জিরানী পর্যন্ত সালনা হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। দায়িত্ব পালনের নামে তাদের এই হয়রানি ব্যবস্থার কারণে ব্যস্ততম সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন তীব্র যানজট লেগেই থাকে। অনেক সময় কোনাবাড়ী ও বাইপাইল এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। এজন্য পরিবহন মালিক, শ্রমিক, সাধারণ যাত্রী ও স্থানীয়রা হাইওয়ে পুলিশকে অভিযুক্ত করেছেন।

কোনাবাড়ী এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন জানান, মহাসড়কে যানজট নিরসনে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ তেমন কোনো ভূমিকাই রাখে না। তারা শুধু যানবাহন আটকিয়ে টাকা কামানোর ধান্ধায় থাকে। তার ভাষ্য, হাইওয়ে পুলিশ তৎপর হলে এ সড়কে যানজট অনেকটাই কমে যেত। শুধু কোনো ভিআইপি এলেই যানজট নিরসনে তাদের তৎপরতা দেখা যায়।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সালনা হাইওয়ে থানার পুলিশ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার (ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে) পথে প্রতিদিন চেকপোস্ট বসিয়ে মামলা ও গাড়ি রেকার করার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে। এছাড়া সড়কে চলাচলরত সিএনজি অটোরিকশা, অটোটেম্পো, লেগুনা, পিকআপ-ট্রাক, লরি, ক্যাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন কোম্পানির মালবাহী যানবাহন থেকে নির্ধারিত টোকেনের মাধ্যমে মাসোয়ারা নিয়ে থাকে। যার পরিমাণ গাড়িপ্রতি ২শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা। ট্রাক-লরি, পিকআপ-ক্যাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার, লেগুনা, ফোর স্ট্রোক (সিত্রনজি), টমটম-ভটভটি, টেম্পো ও মোটরসাইকেল থামিয়ে কাগজপত্র চেকিংয়ের নামে টাকাও আদায় করা হয়।

স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করেন, এ মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা, টেম্পো, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তা চলাচলে বাধা দেয় না। অভিযোগ আছে, কোনাবাড়ী এলাকা থেকে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বাবদ প্রতিদিন ৫০ টাকা, ইজিবাইক থেকে ৩০ টাকা এবং অন্যান্য যানবাহন থেকে তোলা হয় সমপরিমাণ টাকা। এসব টাকা আদায়ের জন্য মাসিক ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা আছে। যাদের একজনের নাম আশরাফুল। এভাবে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করে হাইওয়ে পুলিশ।

হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা সন্ধ্যার পরও যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র চেকিংয়ের নামে চাঁদাবাজি করে। এ নিয়ে প্রতিদিনই হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডা ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, কাগজপত্র দেখার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে রাখা হয়। যখন কেউ পুলিশকে অন্যায়ভাবে টাকা দিতে চান না তখন এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। টাকা না পেলে পুলিশ অনেক সময় চালকদের মারধরও করে।

সম্প্রতি উপজেলার সফিপুর আনসার ভিডিপি একাডেমির পাশে হাইওয়ে পুলিশের এসআই সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ ওই সড়কে চলাচলকারী ট্রাক থামার জন্য সংকেত দেয়। একটি ট্রাক থামাতে দেরি হওয়ার কারণে ওই পুলিশ কর্মকর্তা ট্রাকচালককে লাঠি দিয়ে বেদম পেটাতে থাকে। এ সময় পুলিশের অপর সদস্য ট্রাকের লুকিং গ্লাস ভেঙে ফেলে। এ রকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। যানবাহন থামানোর নাম করে বেশির ভাগ যানবাহনের লুকিং গ্লাস, হেডলাইট, সাইট লাইট, জানালার গ্লাসসহ বিভিন্ন অংশের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। দেয়া হয় মিথ্যা মামলা। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিন কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক আমবাগান, আনসার একাডেমি, চন্দ্রা ফরেস্ট ডাংকবাংলো, স্কয়ার ও বংশাই এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়। এসব চেকপোস্ট থেকে মোটরসাইকেল চালকদের বেশি হয়রানি করা হয়।

দুদিন আগে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারের পশ্চিম পাশে একজন ট্রাকচালককে ভয় দেখিয়ে দু’দফায় ৬ হাজার টাকা আদায় করা হয়। রেকার দিয়ে ট্রাকটি থানায় নেয়ার ভয় দেখিয়ে পুলিশের দুটি টিম এভাবে নাজেহাল করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী এক ট্রাকচালক বলেন, ফেনীর গাউছিয়া এলাকা থেকে গমের গুঁড়া ভরে রাজশাহী যাচ্ছি। এখানে পৌঁছে রাত সাড়ে ৩টার দিকে ট্রাকটি বিকল হয়ে যায়। পরে ট্রাকটি রাস্তার একপাশে রেখে মেরামত করছিলাম। এ সময় ফাঁড়ির এএসআই সোহেল ও পুলিশের গাড়িচালক নজরুলসহ তিনজন ট্রাকের কাছে আসে। পরে ট্রাকটি পুলিশের রেকার দিয়ে থানায় নেয়ার ভয় দেখিয়ে ৩ হাজার টাকা নেয়। এর ঘণ্টাখানেক পরই পুলিশের অপর একটি টিম এসে একইভাবে ভয় দেখায়। বাধ্য হয়েই আবার ৩ হাজার টাকা দিতে হয়।

উল্লেখিত বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সালনা হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ দাউদ বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সঠিক নয়। যানজট নিরসনে তাদের ফোর্স নিয়ে সব সময় রাস্তার ওপর থাকতে হয়।’

“কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

ad

পাঠকের মতামত