জাল দলিলে সাব রেজিস্ট্রি অফিসই বিক্রি করল প্রতারক চক্র
যে অফিসে বসে দলিল রেজিস্ট্রি হয়, সেই সাবরেজিস্ট্রি অফিসই ভুয়া দলিলে বিক্রি করে দিয়েছে একটি ভূমিদস্যু প্রতারক চক্র।
ভুয়া দাতা সেজে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বিক্রির এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। জমির মালিক অভিযোগ দাখিলের পর প্রতারক দাতা-গ্রহীতা আর শনাক্তকারীরা ভুল স্বীকার করেছেন। দাতা-গ্রহীতা আর দলিল লেখকের ওপর দায় চাপিয়ে সাবরেজিস্ট্রার বলছেন, কীভাবে আমমোক্তারনামা দলিলটি বাতিল করা যায় তার একটি পথ বের করা হবে।
সাবরেজিস্ট্রার আবদুল মতিন বলেন, জমির মালিকানা হস্তান্তরের সময় দাতা-গ্রহীতা সবাই ছিলেন। ছিলেন শনাক্তকারীও। কিন্তু যাকে দাতা সাজানো হয়েছে তিনি যে ওই জমির মালিক নন, সেই সঙ্গে দাতা-গ্রহীতা ও শনাক্তকারীরা পরস্পর যোগসাজশে যে এমন প্রতারণার আশ্রয় নেবেন তা তিনি বুঝতে পারেননি। এই চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্পাদিত দলিল আইনি প্রক্রিয়া তথা মামলা ছাড়া বাতিল করা যায় না। এজন্য জমির মালিককে পোহাতে হবে আইনি ঝামেলাসহ বহু বিড়ম্বনা। তারা এও বলছেন, জাল দলিলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বিক্রির দায় এড়াতে পারেন না সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রার ও এই অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসই যেখানে ভুয়া মালিক সেজে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে সেখানে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার দলিল যে ঠিক হচ্ছে, প্রতারণার ঘটনা ঘটছে না, একজনের জমি অন্যের নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়া হচ্ছে না তার নিশ্চয়তা কী।
জানা গেছে, সাতকানিয়া পৌর সদরের পশ্চিম ঢেমশা মৌজার আরএস ৩১৭০ ও ৩১৭১ এবং বিএস ৫৫০২ ও ৫৫০১ দাগের ৪০ শতক জমি উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক আইয়ুব আলী ও আহমদুল কবির চৌধুরী গং। এই জমিতে স্থিত রয়েছে সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, মুন্সিখানা, কৃষি ব্যাংক, হোটেল-নার্সারি ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে ভোগ করে আসছেন আইয়ুব আলী ও আহমদুল কবির গং। তারা এই জমির নিয়মিত কর-খাজনাও দিয়ে আসছেন। ১ আগস্ট নুর আহমদ প্রকাশ নুরুল আলম নামে এক ব্যক্তি জমির মালিক সেজে এই দাগের ২০ শতক বিক্রি করে দেন ৭৬ লাখ টাকায়। আমমোক্তারনামা দলিলের মাধ্যমে (দলিল নম্বর ২৯১৫) এই জমির গ্রহীতা হলেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন রাসেল, তরিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ এরশাদ। দলিলটি সম্পাদন করেন তৌহিদুল ইসলাম। দলিলে শনাক্তকারী তথা সাক্ষী ছিলেন ওয়াহিদুল ইসলাম ও মুহাম্মদ সোহেল। ৩ আগস্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের জমি নিজের দাবি করে দখল করতে যান গ্রহীতা তরিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ এরশাদসহ অন্যরা। কার জমি কে বিক্রি করল এটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে জমির মালিকরা হতভম্ব হয়ে যান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নুর আহমদ পিতা- আহম্মদ আলী (৭৪) হিসেবে যাকে দাতা দেখানো হয়েছে তিনি মারা গেছেন ২০০১ সালে। সাতকানিয়ার পৌর মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের এ সংক্রান্ত ডেথ সার্টিফিকেটও দিয়েছেন। মূলত নুর আহমদের সঙ্গে ‘ওরফে নুরুল আলম’ নাম যুক্ত করে জালিয়াতির মাধ্যমে জমি হস্তান্তর করা হয়।
জমির প্রকৃত মালিকদের একজন আহমদুল কবির জানান, এই প্রতারণার বিষয়ে তারা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত অভিযোগ পেয়ে সাতকানিয়া থানা পুলিশ অভিযুক্ত দাতা-গ্রহীতাদের ডেকে পাঠালে তারা সাড়া দেননি। প্রতারক নুর আহমদকে অন্যের জমি বিক্রির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। তবে তিনি সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রারকে বলেছেন, তার ভুল হয়ে গেছে। তিনি এফিডেভিট দিয়ে ওই দলিল বাতিলের আবেদন জানাবেন।
সাতকানিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ভুয়া মালিক সেজে স্বয়ং সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বিক্রি করে দেয়ার এ ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। দলিলে যাকে দাতা সাজানো হয়েছে তিনি এ দলিল সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। তবে গ্রহীতাদের নোটিশ পাঠিয়ে ডাকা হলেও তারা সাড়া দিচ্ছেন না।
সাতকানিয়ার সাব-রেজিস্ট্রার আবদুল মতিন বলেন, আমমোক্তারনামা দলিলে যিনি দাতা সেজেছেন তিনি লোভে পড়ে এটি করেছেন বলে জানিয়েছেন। ভুল স্বীকার করে এফিডেভিটের মাধ্যমে এই দলিল বাতিলের আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন। এই আবেদন আসার পর জেলা রেজিস্ট্রারের সঙ্গে আলাপ করে কীভাবে দলিলটি বাতিল করা যায় তার একটি পথ বের করা হবে।
ভুয়া দলিলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বেচাকেনার দায় একজন সাব-রেজিস্ট্রার এড়াতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মতিন বলেন, এই দায় দলিল লেখকদের, দাতা-গ্রহীতা ও শনাক্তকারীর। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, দাতা-গ্রহীতা শনাক্তকারী সবাই সাক্ষ্য দিলে দলিল সম্পাদন না করার উপায় সাব-রেজিস্ট্রারের থাকে না। প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।