দুদকের গ্রেফতার আতঙ্কে ব্যাংকাররা

acc_dudak_bbc_nocreditরাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব নেয়ার পর পরই গত ৩০ জুন গ্রেফতার হন মিজানুর রহমান খান। একই দিন গ্রেফতার হন ব্যাংকটির আরো দুই কর্মকর্তা ডিজিএম আখতারুল আলম ও এজিএম শফিউল্লাহ। নিয়ম ভেঙে মুন গ্রুপকে ঋণ দেয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রেফতার করে তাদের।

সর্বশেষ গতকাল গ্রেফতার করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা বংশাল শাখার সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ইনচার্জ মো. শামছুদ্দিন ও একই শাখার সাবেক এভিপি মো. ইনামুল হককে। ১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করে দুদক। প্রায় ৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একই দিন গ্রেফতার করা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের চাঁপাইনবাবগঞ্জের চুকিত্তি শাখার সেন্টার ইনচার্জ মো. আব্দুল কাইয়ুমকে। এভাবে গত প্রায় পাঁচ মাসে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের অর্ধশতাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে দুদক। এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অন্য ব্যাংকারদের মধ্যেও।

ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ-সংক্রান্ত কোনো কাগজে স্বাক্ষরের আগে দশবার ভাবতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। এতে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহকের ঋণ না পাওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। যদিও দুদকের দাবি, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই ব্যাংকারদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। যারা দুর্নীতি করবেন, তাদের গ্রেফতারে এ অভিযান চলবে।

দুদকের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে চলতি বছরের ১৩ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মোট ২১২ জনকে গ্রেফতার করেছে দুদক। গ্রেফতারের তালিকায় রয়েছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ব্যাংক কর্মকর্তা, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, ঠিকাদার, শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ব্যাংকার। গ্রেফতারকৃতদের এক-চতুর্থাংশের বেশি অর্থাৎ ৫৯ জনই সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকার। ঋণ অনিয়মের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের। আর এ ঋণ অনিয়মের মূল সুবিধাভোগী যারা, সেই ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছেন ২২ জন।

বিপুল সংখ্যক ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রেফতারের ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে বলে জানান ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সহসভাপতি ও বেসরকারি ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঋণ-সংক্রান্ত কোনো কাগজে স্বাক্ষর করলে দুদক তাকে ধরে নিয়ে যাবে কিনা, সে বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে ব্যাংকারদের। এতে ঋণ অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি ভালো গ্রাহকও ঋণবঞ্চিত হতে পারেন। তাই ব্যাংকারদের গ্রেফতারের আগে দুদকের দেখা উচিত, কেউ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন।

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে সবচেয়ে বেশি গ্রেফতার হয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা। গত ১৩ মার্চ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের ১০ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে দুদক। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের ছয়জন করে, রূপালী ব্যাংকের চারজন, বেসিক ব্যাংকের দুজন, জনতা ব্যাংকের একজন, বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চারজন করে এবং আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছেন দুদক কর্মকর্তারা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পাঁচজন; পূবালী ব্যাংকের তিনজন, স্ট্যান্ডার্ড, ব্যাংক এশিয়া, আইসিবি ইসলামিক ও ইসলামী ব্যাংকের দুজন করে এবং শাহ্জালাল ইসলামী, যমুনা, এবি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের একজন করে কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ প্রদান, ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, স্বাক্ষর জাল করে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন, গ্রাহকের এফডিআরের টাকা আত্মসাত্সহ বিভিন্ন অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, যারাই দুর্নীতি করবে, তাদেরই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।

ঋণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে গত ৩০ জুন অপসারণ করা হয় অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদকে। ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেয়া হয় ব্যাংকটির ডিএমডি মিজানুর রহমান খাঁনকে। ওইদিন বিকালেই দুদকের অভিযানে গ্রেফতার হন তিনি। একই দিন গ্রেফতার হন ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন আরো দুই কর্মকর্তাও। এমডির অপসারণ ও ভারপ্রাপ্ত এমডিসহ ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটির অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, আমি মনে করি, দুদক তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। তবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের খেয়াল রাখতে হবে, যেন ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেদিকে। মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাউকে গ্রেফতার করা ঠিক নয় বলে আমার কাছে মনে হয়। ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলার অভিযোগপত্র দেয়ার পর গ্রেফতার করা উচিত। এফআইআর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে গ্রেফতার করা হলে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়।

তিনি বলেন, দুদকের অভিযানে অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হতে দেখেছি, যা অপ্রয়োজনীয়ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ অপ্রয়োজনীয় প্রচারে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে। ফলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে দেশের আর্থিক খাতে। দুদকের অভিযান চললেও ব্যাংকগুলোর বড় বড় খেলাপি ও কেলেঙ্কারির নায়কদের কিছুই হচ্ছে না। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তারা।

গত ১৬ জুলাই রাতে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী, তার স্ত্রী, দুই ভাইসহ এবি ব্যাংকের সাবেক দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় মামলা হওয়ার পর ওই রাতেই গ্রেফতার হন ব্যাংটির সাবেক ডিএমডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বদরুল হক খান। প্রায় ৩২৫ কোটি টাকা আত্মসাতে সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। এ ঘটনায়ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংকপাড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, দুদকের কাছে আসা অভিযোগের ভিত্তিতেই কাজ করেন তারা। অভিযোগের কারণে কিংবা দুদকের পর্যবেক্ষণের ফলে কোনো একটা খাতে নির্দিষ্ট সময়ে গ্রেফতারের ঘটনা বেশি ঘটতেই পারে। তবে কেউ গ্রেফতার হলেই যে সে অপরাধী, এমনটা নয়। বিচার প্রক্রিয়ায় যদি আসামি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তিনি মুক্তি পাবেন। এ অভিযানের ফলে ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না।দুদকের অভিযানে ছোট ছোট আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্তরাই বেশি গ্রেফতার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বড় বড় আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এটি দুর্নীতির মূলোত্পাটনে মোটেই সহায়ক নয়। অপরাধী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমনকি বড় ব্যবসায়ী হলেও যেন তারা ছাড় না পান, সে বিষয়টি দেখতে হবে।

ad

পাঠকের মতামত